‘ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলে আইনি ব্যবস্থা’
টেলিভিশন টক শোতে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন’ বলায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে প্রকাশ্যে অপরাধ স্বীকার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন নারী সাংবাদিকরা। তা না হলে তারা আইনের আশ্রয় নেবেন।
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু এ কথা জানান। এ সময় মাসুদা ভাট্টি ছাড়াও নারী নেত্রী, সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
গত ১৬ অক্টোবর একাত্তর টেলিভিশনের টক শো ‘একাত্তরের জার্নাল’ এ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি প্রশ্ন করেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আপনি যে হিসেবে উপস্থিত থাকেন- আপনি বলেছেন আপনি নাগরিক হিসেবে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, আপনি জামায়াতের প্রতিনিধি হয়ে সেখানে উপস্থিত থাকেন।’
মাসুদা ভাট্টির এই প্রশ্নে রেগে গিয়ে মইনুল হোসেন বলেন, ‘আপনার দুঃসাহসের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনি চরিত্রহীন বলে আমি মনে করতে চাই। আমার সঙ্গে জামায়াতের কানেকশনের কোনো প্রশ্নই নেই। আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তা আমার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর।’
সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি মূল বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ‘ওই টক শোতে মাসুদা ভাট্টি অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাকে প্রশ্ন করেন এবং এরকম ন্যাক্কারজনক মন্তব্যের পর তিনি ওই ব্যক্তিকে কোনো কটূক্তি করেননি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের এই বক্তব্যকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়া যায়। আমরা মনে করি করছি যে, মাসুদা ভাট্টি একজন নারী বলে তিনি সরাসরি তাকে চরিত্রহীন বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। কারণ, নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি অনেকেরই বাহবা পাবেন এবং এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।’
তিনি বলেন, ‘এই অস্ত্র প্রয়োগে একজন প্রবীণ আইনজীবী হয়েও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি মাসুদা ভাট্টিকে আক্রমণ করতে গিয়ে সকল নারীকে অপমান করেছেন এবং এ জন্য তার যথাযোগ্য শাস্তি আমরা দাবি করছি।’
নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, ‘ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ব্যক্তিগতভাবে মাসুদা ভাট্টির কাছে ফোন করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন বলে আমরা জেনেছি। কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনা যথেষ্ট নয়। কারণ, আমরা আগেই বলেছি যে, উনি শুধু ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছেন তাই নয়, তিনি সমগ্র নারী তথা সাংবাদিক সমাজকে আক্রমণ করেছেন। এর চেয়ে বড় কথা হলো, তিনি কোনোভাবেই একজন সাধারণ মানুষকেও এভাবে চরিত্রহীন বলে আক্রমণ করতে পারেন না। তিনি নারী হন কী পুরুষ হন, তাতে কিছুই এসে যায় না। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেখানে এ ধরনের ব্যক্তি আক্রমণের কোনো সুযোগ নেই।’
দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় আমরা বাংলাদেশের সকল নারী তথা নাগরিকের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি যে- ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে প্রকাশ্যে তার অপরাধ স্বীকার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ভবিষ্যতে তিনি এরকম ব্যক্তি আক্রমণ থেকে বিরত থাকবেন।’
‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি এই দাবি-দাওয়া না মানলে আমরা আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব। দেশের গণমাধ্যমের কাছে আহ্বান জানাব- কথা বলার জন্য যাতে তাকে কোনো প্রকার সুযোগ না দেয়া হয়। একই সঙ্গে আমরা নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন জানাতে চাই যে, একজন নারী সাংবাদিককে অপমান করতে দ্বিধা করেন না এমন কোনো ব্যক্তিকে যেন নেতৃত্বের জায়গায় না রাখা হয়। কারণ, এর ফলে এই ঐক্যফ্রন্ট কেবল বিতর্কিতই হবে’,-বলেন নাসিমুন আরা মিনু।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের উদ্দেশ্যে মাসুদা ভাট্টির লেখা একটি খোলা চিঠি সাংবাদিকদের সরবরাহ করা হয়। অনুষ্ঠানে মাসুদা ভাট্টি ওই চিঠিটি পড়ে শোনান। সেখানে তিনি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘...আমার দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি যে, যুক্তিহীন মানুষই সাধারণত ব্যক্তিগত আক্রমণ করে এবং একজন নারীর ক্ষেত্রে সবসময় তার চরিত্রকে নির্দেশ করেই এই আক্রমণ করা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আপনিও এর ব্যতিক্রম নন।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে বিষয়টিতে আর আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভের ব্যাপার নেই। কারণ, আমি মনে করছি, আমাকে বা যে কোনো নারীকে এরকম আক্রমণের শিকার হয়ে এগোতে হবে। বিষয়টি এখন বাংলাদেশে গণমাধ্যমকর্মীসহ সকল পেশাজীবী নারী ও সচেতন নাগরিকদের উপর আঘাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আঘাতকারী যখন একজন প্রবীণ আইনজীবী হন তখন এটি আর আঘাত না থেকে হয়ে ওঠে চরম অপমানকর, অবমাননাকর ও আইনের লঙ্ঘনও।’
মাসুদা ভাট্টি ব্যারিস্টার মইনুলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় যখন আপনি আমাকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে ক্ষমা চাইলেন তখনই আপনাকে আমি এ কথা বলেছি, যে অন্যায় কাজটি আপনি করেছেন একটি জনপ্রিয় টেলিভিশন টক শোতে, যার সাক্ষী অনুষ্ঠানটির লাখ লাখ দর্শক। তাদের অগোচরে আপনি একটি ফোন করে ক্ষমা চাইলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ক্ষমা করলেও যে অগণিত নারীকে আপনি অপমান করেছেন তাদের ক্ষোভ কোনোভাবেই তাতে প্রশমিত হয় না।’
‘সুতরাং বিষয়টি ঘটেছে জনসম্মুখে, সেহেতু আপনাকে আপনার বক্তব্য প্রত্যাহার করে, অপরাধ স্বীকার করে সকল পক্ষের কাছেই প্রকাশ্যে মার্জনা চাওয়াটা কাম্য। আশা করি, আপনি আমার ও আমার মতো অসংখ্য নারীর সম্মানহানিন ক্ষত’র জায়গাটি উপলব্ধি করবেন এবং প্রকাশ্যে সকলের কাছে মার্জনা প্রার্থনা করবেন,’- মইনুলের উদ্দেশ্যে বলেন ভাট্টি।
সংবাদ সম্মেলনে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘নারী চরিত্রহননের অভিজ্ঞতা না থাকলে এভাবে প্রকাশ্যে কোনো নারীকে চরিত্রহীন বলা যায় না। ব্যরিস্টার মাইনুলের জানা দরকার, বেশি হইচই করলে থলের বিড়ালটি কিন্ত বেরিয়ে পড়বে অচিরেই। এই যে আন্দোলন শুরু হলো, এটা যেন চরম লক্ষ্যে আঘাত না হানা পর্যন্ত শেষ না হয়।’
এটিএন নিউজের হেড অফ নিউজ মুন্নি সাহা বলেন, ‘এই প্রতিবাদ সকল রাজনৈতিক কলঙ্কিত চরিত্রহীনদের প্রতি প্রতিবাদ। যারা রাজনীতি করবেন, যারা জাতীয় ঐক্য করছেন, নির্বাচনের কথা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছেন- একটু আজকের এই প্রতিবাদটা মাথায় নিয়ে আপনারা মাঠে নামবেন।’
গাজী টেলিভিশন (জিটিভি), সারাবাংলা ডটনেট-এর এডিটর-ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘আমি সংহতি জানাতে এখানে এসেছি। ব্যারিস্টার মইনুল যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা শুধু নারীকে অপমান করেনি, মানুষকে অপমান করা হয়েছে। ব্যারিস্টার মইনুলের দাম্ভিকতা আমরা অনেক দিন ধরে দেখছি। তিনি ১/১১ সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, যে সরকারকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যারিস্টার মাইনুলকে কোনো টক শোতে রাখতে চাই না। আমরা বন্ধুদেরও অনুরোধ করেছি, তারাও যাতে তাকে কোনো টেলিভিশন টক শোতে না ডাকেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আমার সাংবাদিক ভাই ও বোনদের অনুরোধ করব ব্যরিস্টার মইনুল যে জনসভায় থাকবেন, সেই জনসভার সংবাদ কভার করা হবে না। আমি এটা মানতে চাই। আমি আমার তিনটি প্রতিষ্ঠানের সবাইকে এটা বলে দিয়েছি। ব্যারিস্টার মইনুল শুধু নারীর শত্রু নন, তিনি এখন গণশত্রু। তার ক্ষমা নেই, ক্ষমার বাইরে যদি কোনো শাস্তি থাকে, আপনারা সেটা নিয়ে চিন্তা করতে পারেন।’
সাংবাদিক আঙ্গুর নাহার মন্টির সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে নারী উন্নয়নকর্মী রোকেয়া কবির, ব্যারিস্টার তানিয়া আমির, ডা. নুজহাত চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আরএমএম/জেডএ/আরআইপি/জেআইএম