এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ‘মানসিক চাপে’ ঢাকাবাসী
এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ঢাকাবাসী সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপের মধ্যে আছে বলে এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি বাণিজ্যিক সংস্থা জিপজেট-এর তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতে বাস করা সবচাইতে স্ট্রেসফুল বা মানসিক চাপের ব্যাপার।
পাশাপাশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ঢাকাবাসী মানুষের মানসিক চাপ কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষের যেমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়, তেমনি বেসরকারিভাবেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। গবেষণায় বায়ু দূষণ, যানজট, লিঙ্গ বৈষম্য, বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্যের মতো বিষয়ের মানদণ্ডে বিশ্বের ১৫০টি শহরের তালিকা করা হয়েছে।
ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন- এমন কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে বিবিসি। এদের সবারই বয়স ত্রিশের ওপরে এবং সবাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- এই শহরে বসবাসের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো তাদের নিয়মিত মানসিক চাপে ফেলে দেয়?
এ প্রশ্নের জবাবে একজন বলেছেন, ঢাকার প্রতিটা মোড়ে, প্রতিটা সিগন্যালে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়, বাসা থেকে রোজ সকালে এক ঘণ্টা আগে বের হতে হয়। ধোঁয়া, ধুলার কারণে কোথাও সহজে যাওয়া যায় না, এমনকি শপিং সেন্টারেও দেখবেন ভিড়। যেখানে যাবেন জ্যাম, রাস্তায় দেখবেন ডাস্টবিন উপচে পড়ছে ময়লা। আর খাবারের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতার কোনো গ্যারান্টি নেই।
তিনি বলেন, ‘হাঁটার কোনো জায়গা নেই, এজন্য দেখা যায় ওজন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে এবং ডায়াবেটিস হয়-এগুলোও মানসিক চাপ বাড়ায়।’
আরেকজন বলেন, ‘রাস্তায় জ্যাম, কোনো ট্রাফিক রুলস নেই, গাড়ি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই যাচ্ছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে পানির অনেক সমস্যা, রান্না বা গোসলের জন্য ঠিকমতো পানি পাওয়া যায় না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছি, বাস পাইনি, দুই-তিনবার গাড়ি বদলে আসতে হয়েছে।’
জিপজেটের গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ সৃষ্টির পেছনে শব্দ ও বায়ু দূষণ যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, প্রাকৃতিক পরিবেশের হার কমে যাওয়া, গণপরিবহন ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি বিষয়সমূহ।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিষয় একজন মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্কগুলোর ওপর প্রভাব ফেলছে। এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোবিজ্ঞানী ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘প্রতিদিনের কাজ সম্পন্ন করা যখন কঠিন হয়ে যায় সিম্পল একটা জ্যামের কারণে, তখন সেটা একজন মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে। শহরে দেখবেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক অবিশ্বস্ততা, সেটাও অস্থিরতা থেকে আসতে পারে। আমরা সাময়িক একটা আনন্দের জন্য আমাদের মনটাকে নানাভাবে “চ্যানেলাইজ” করছি।’
বিবিসির বাংলা অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে যে ভীষণ মানসিক চাপের মধ্যে মানুষজন বসবাস করে, তা মোকাবেলার জন্য কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান নয়। বিষয়টিও স্বীকারও করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন।
তিনি বলছেন, ২০১৭ সালের শুরুতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৩১টি খেলার মাঠ ও পার্ক পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করেছে, যাতে মানুষজন সেখানে সময় কাটাতে পারে। পাশাপাশি ‘গোস্বা ঘর’ নামে একটি অভিনব উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেসব এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
‘আমরা ৩১টি খেলার মাঠ ও পার্ক পুনরুদ্ধারের কাজ হাতে নিয়েছি। সেই সঙ্গে আমাদের গ্রামবাংলায় ‘গোস্বা ঘর’ বলে একটা ব্যাপার ছিল, নদীর পাড়ে ছোট একটি কুড়ে ঘর, বাড়িতে ঝগড়াঝাটি মনোমালিন্য হলে মানুষ গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কাজে বা ঘরে ফিরত। আমরা সেই ভাবনা থেকে শহরে একটি ‘অ্যাংগার রিডাকশন ম্যানেজমেন্ট পার্ক’ শুরু করি। আগামী বছরের শুরুতে সেটি সবার জন্য খুলে দেবার আশা আছে।’-বলেন মেয়র।
তবে মানসিক চাপ কমানোর বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানী ডা. মেখলা সরকার। তিনি বলেন, ‘মানসিক চাপ সামালানোর জন্য প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো নাগরিককে সচেতনভাবে কিছু চেষ্টার মধ্যে থাকতে হবে। নিজের শরীরে প্রতি যত্নবান হতে হবে, নিজেকে সময় দেয়া, নিয়ম করে মানুষের সাথে যোগাযোগ তৈরি করা- মানে পার্টি-কালচারের মতো নয়, সত্যিকারের যোগাযোগ তৈরি করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হিসাবে এই মুহূর্তে যে শহরের জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি, অর্থাৎ প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ বাস করে, সে শহরকে মানুষের জন্য একটু স্বস্তিকর করতে হলে কর্তৃপক্ষের আশু উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
এসআর/পিআর