ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

থেমে যাবেন বলে স্বপ্ন দেখেননি আবদুস সাত্তার (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রকাশিত: ১২:৩২ পিএম, ০৯ আগস্ট ২০১৫

প্রিয় পাঠক, শনিবার গাড়ি চালিয়ে বিশ্বভ্রমণে বের হওয়া কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা আবদুস সাত্তারের আমলাতান্ত্রিক হয়রানির কথা প্রথম পর্বে প্রকাশ করেছিলাম। আজ (রোববার) দ্বিতীয় পর্বে হয়রানির বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-

আবদুস সাত্তারের ধারাবাহিক হয়রানির ঘটনাটি সংক্ষেপে এ রকম। তিনি বাংলাদেশে পৌঁছে ২০১০ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাড়িটি ছাড়ানোর জন্য কমলাপুর আইসিডির শুল্ক কর্মকর্তার দপ্তরে যান। সেখানে তাঁকে জানানো হয়, প্রধান নিয়ন্ত্রক, আমদানি-রফতানি (চিফ কন্ট্রোলার অব ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট) দপ্তরের ছাড়পত্র লাগবে। ২২ মে প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে গেলে জানানো হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। আড়াই মাস বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ঘোরাঘুরির পর ওই বছরের ১১ আগস্ট তিনি মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পান। এরপর প্রধান নিয়ন্ত্রকের ছাড়পত্র নিয়ে ১৮ আগস্ট যান চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ে।

এবার শুল্ক বিভাগ বলে, রাজস্ব অধিদপ্তরের (এনবিআর) ছাড়পত্র লাগবে। এনবিআর কর্মকর্তারা গাড়িটির দাম ধরে ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিয়ে ছাড়ানোর পরামর্শ দেন। তিনি আবার যান চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগে। সেখান থেকে জানানো হয়, গাড়িটি ছাড়াতে এক কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি লাগবে। এতো টাকা তিনি পাবেন কোথায়? আবার শুরু হলো গ্যারান্টি মওকুফের জন্য দৌড়ঝাঁপ। শেষ হয় না হয়রানির।

এমনই দৌড়ঝাঁপের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার গণমাধ্যমের নজর কাড়েন। তাঁকে নিয়ে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রচারিত হয় বিশেষ প্রতিবেদন। সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বছর তিনেক আগে তাঁর সমর্থনে মানববন্ধন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আবেদন, একাধিক মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ইত্যাদি পর্বও সারা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরের বক্তব্য, ভ্রমণের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নিতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। এই ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ থাকলে বিনা শুল্কে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নেওয়া যায়। আসার আগে এই অনুমতি নেননি আবদুস সাত্তার।

এ বিষয়ে আবদুস সাক্তারের বক্তব্য, তার ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ ছিল। কিন্তু তুরস্ক পুলিশের একটি দল তাঁর কাছে থাকা নগদ অর্থসহ সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সেখানেই তিনি কাগজটি হারান।

জানা গেছে, ২০১২ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছিল, তাঁর ক্ষেত্রে ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ লাগবে না। বাংলাদেশ অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের সুপারিশপত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেই গাড়িটি ছাড়পত্র পাবে। অনেক কষ্টে সেই সুপারিশপত্র জোগাড় করে ওই বছরের জুন-জুলাইয়ের দিকে তিনি আবেদন করেন চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগের উপ-কমিশনারের কাছে।

শুল্ক বিভাগের ভাষ্য মতে, ট্রানজিট গাড়ি দেশে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে যে কেউ তাঁর গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে পারেন। ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ’ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আর ট্রানজিট গাড়ি দেশে প্রবেশের দায়িত্ব অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের।

শেষ পর্যন্ত ৭৪ হাজার টাকা দিয়ে গাড়িটির বীমা করিয়েছেন আবদুস সাত্তার। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মনোয়ারা খানম এ বছরের এপ্রিলে তাঁর পক্ষে রিট আবেদন করেছেন। গাড়িটি নিয়ে আবার বিশ্বজয়ে পথে নামবেন- থমকে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তারের এই স্বপ্ন এখনো বহাল।

জানা গেছে, ২০০৯ সালের মে মাসে করাচি বন্দর থেকে সাত্তারের মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার ২০০৬ মডেলের গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে জাহাজে তুলে দিয়েছেন আবদুস সাত্তার। ঢাকায় এসে গাড়ি ছাড় করতে যান কমলাপুর আইসিডির শুল্ক কর্মকর্তার দফতরে। উপ-কমিশনার কাগজপত্র দেখে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনা করে জানালেন, বিশ্বভ্রমণে এলেও গাড়িটি ছাড় করাতে প্রধান নিয়ন্ত্রক, আমদানি-রফতানি (চিফ কন্ট্রোলার অব ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট) দফতরের ছাড়পত্র লাগবে। ২২ মে প্রধান নিয়ন্ত্রকের দফতরে ধরনা। জানানো হয়, তাদের কাছে নয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে। কিন্তু বিশ্বভ্রমণকারী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ঠাঁই করতে পারছিলেন না।

দুই যুগ ধরে কানাডায় বসবাসকারী আবদুস সাত্তার বলেন, ‘তাঁর বাড়ি বাংলাদেশের যশোরে। যশোরের চৌগাছা উপজেলার চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তিনি যশোর-২ আসনের সাবেক সাংসদ মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদের সঙ্গে পরিচিত হন। এরপর তাঁর সুপারিশ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যান। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় খোদ সাংসদকে নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দরখাস্ত জমা দিতে সক্ষম হন। আড়াই মাস পর গত ১১ আগস্ট তিনি মন্ত্রণালয়ের ওই ছাড়পত্র পান। এই আড়াই মাসে প্রায় প্রতি কার্যদিবসে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ধরনা দিয়েছেন।

এই ছাড়পত্র নিয়ে সাত্তার আবার যান প্রধান নিয়ন্ত্রক, আমদানি-রফতানির দফতরে। ১৮ আগস্ট সেখান থেকে ছাড়পত্র নিয়ে যান চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ে। সেখানে যাওয়ার পর শুল্ক কর্মকর্তারা বলেন, ‘এত ছাড়পত্রের দরকার নেই। এগুলো কেবল বিদেশিদের জন্য প্রযোজ্য।’সাত্তার জানান, তিনি বিদেশি নাগরিক এবং কানাডার নাগরিক হিসেবেই তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছেন। জবাব, ‘আপনি তো দেখতে বাংলাদেশিদের মতো। এ ছাড়পত্র আপনার জন্য না।’তাহলে আমাকে কী করতে হবে? জানতে চান সাত্তার। পরামর্শ-আপনি রাজস্ব অধিদপ্তরে (এনবিআর) যান।

আবদুস সাত্তারের জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তাঁকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, ১৫ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা না নিলে আপনার গাড়িটি নিলাম করা হবে। সাত্তার দ্রুত ছুটে যান এনবিআরে। লিখিত আবেদন করে নিলাম স্থগিত করাতে সক্ষম হন। এবার চট্টগ্রাম শুল্ক কার্যালয়ের পরামর্শে দরখাস্ত করেন এনবিআরে। ২০১০ সেপ্টেম্বর এনবিআর তাঁকে চিঠি দিয়ে জানায়, গাড়ির দাম ধরে ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিয়ে গাড়িটি ছাড় করাতে পারবেন তিনি। এই পত্র নিয়ে সাত্তার যান চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগে। সেখানকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সাদা কাগজে একটি খসড়া হিসাব দিয়ে তাঁকে ৯৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দিতে বলেন।
কিন্তু এত বড় অংকের টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার অবস্থা এখন আর সাত্তারের নেই। তাছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশে এমন ব্যাংক-জিম্মা দিতে হয়নি তাঁকে।

বিশ্ব ভ্রমণকারীর জন্য চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের সর্বশেষ পরামর্শ ছিল- এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে বিশেষ বিবেচনার জন্য আবেদন করেন। আবার এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করা হয়। দুই সপ্তাহ পর এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব রেজাউল হকের জবাব, ‘এ ব্যাপারে চেয়ারম্যান মহোদয়ের কিছু করার নেই। এটা তার ক্ষমতার বাইরে।’

এনবিআরের দাবি, ভ্রমণের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নিতে হলে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়, যাকে বলে ‘কারনেট দ্য প্যাসেজ্।’ এটি থাকলে বিনা শুল্কে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গাড়ি নেওয়া যায়। দেশে আনার আগেই তাঁকে এই অনুমতি নিতে হতো। কিন্তু তিনি এই অনুমতি নিয়ে আসেননি।

অন্য দেশগুলোতে তো তিনি এই সমস্যায় পড়েননি। সবাই তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ কি গত ৫ বছরে সমস্যার সমাধান করতে পারত না? এনবিআর আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে না। গাড়ির দাম অনুযায়ী এক কোটি টাকা জিম্মি ব্যাংক গ্যারান্টি প্রয়োজন।

আবদুস সাত্তার জানান, সেখান থেকে রেহাই পেয়েছে। তবে এখন কনটেইনার ভাড়া, পোর্ট ট্যাক্স, পার্কিং ইত্যাদি বাবদ প্রায় ৬০ লাখ টাকার ওপরে বিল এসেছে। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবেন তিনি এই বিপুল পরিমাণ অর্থ।

এই স্বপ্নবাজ বলেন, ‘পরিকল্পনা ছিল, বাংলাদেশ ঘুরে সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড-মিয়ানমার-চীন যাওয়ার। তারপর মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো ঘুরে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে কানাডা ফিরব। কিন্তু এখন সব ভেস্তে যেতে বসেছে।’

সূত্র বলছে, বিদেশ থেকে কোনো গাড়ি আনলে এলসি থাকতে হয়। এলসি না থাকলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আনতে হবে। কারণ, গাড়ি তো আর শুল্ক ছাড়া দেওয়া যায় না। এ কারণে তাঁর কাছে শুল্ক দাবি করে।

‘নিজেকে জানো, বিশ্বকে জানো’ স্লোগান নিয়ে সাত্তাররা বিশ্বভ্রমণ শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশকে ‘জেনে’ সে ভ্রমণ এখন প্রায় বাতিলের খাতায়। পরিবেশ বাঁচাও, পৃথিবী বাঁচাও; স্বাস্থ্য বাঁচাও, পরিবার বাঁচাও-এ ছিল তাঁদের সচেতনতামূলক প্রচার। এখন সাত্তার নিজে বাঁচতে চান।

আগামীকাল সোমবার ধারাবাহিক আয়োজনের তৃতীয় পর্ব পড়তে চোখ রাখুন জাগোনিউজ২৪.কম এর পাতায়।

# আমলাতন্ত্রের গোলক ধাঁধায় বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন (প্রথম পর্ব)

এসএ/আরএস/এইচআর/আরআইপি