ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

সরকারি মেডিকেলে ‘প্রমার্জনাপ্রাপ্ত’ অধ্যাপকের ছড়াছড়ি

প্রকাশিত: ০৪:৫০ পিএম, ০৬ আগস্ট ২০১৫

দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে এখন ‘প্রমার্জনাপ্রাপ্ত’ অধ্যাপকের ছড়াছড়ি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিগত ছয় বছরে দুই সহস্রাধিক চিকিৎসককে সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত এই শিক্ষকদের প্রায় এক হাজারই রাষ্ট্রপতির বিশেষ প্রমার্জনায় পদোন্নতি পেয়েছেন!

সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে শুধুমাত্র ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকরাই যোগ্যতা ও সিনিয়রিটি অনুসারে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, বিগত ছয় বছরে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা ও রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনায় ক্যাডার কর্মকর্তা ছাড়াও, নন-ক্যাডার ও প্রকল্পভুক্ত চিকিৎসকদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার সুযোগে কোনো কোনো চিকিৎসক সাধারণ এমবিবিএস চিকিৎসক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে গেছেন। ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে একাধিকবার পদোন্নতি পেয়েছেন। বিশেষ করে দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির প্রমাজর্নায় বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক শিক্ষক পদোন্নতি পেয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, প্রমার্জনার মাধ্যমে শিক্ষকদের পদোন্নতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্বের কোনো দেশে এ ধরনের পদোন্নতির নজির নেই।

তিনি বলেন, চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অত্যাবশ্যক। সেক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে যাদের শিক্ষক বানানো হলো তারা ভবিষ্যতে ছাত্রছাত্রীদের কী শিক্ষা দেবে! প্রমার্জনার এ রীতির মাধ্যমে চিকিৎসা শিক্ষার মানের আরো অবণতি ঘটবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরো কয়েকজন সিনিয়র চিকিৎসক শিক্ষক জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি চাকরিবিধি অনুসারে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক, সহযোগী  অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে চাকরি স্থায়ী ও নিয়মিতকরণ, নির্দিষ্ট মেয়াদে শিক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞতা, উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষা ডিগ্রি থাকা ও নির্দিষ্ট সংখ্যক পাবলিকেশন থাকা জরুরি। কিন্তু রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার নামে অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি।

সর্বশেষ বুধবার ৩৪৬ জন সহকারী অধ্যাপককে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ পদোন্নতির ক্ষেত্রে ২০তম বিসিএসের কোনো চিকিৎসক ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি। অথচ কয়েকমাস আগে ২০তম বিসিএসের কোনো কোনো চিকিৎসক ও নন-ক্যাডার চিকিৎসককে পদোন্নতি দেয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চিকিৎসক জাগো নিউজকে বলেন, রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার যে ধারা চালু হয়েছে তাতে দলীয় আশীর্বাদ না থাকলে পদোন্নতি কখনোই পাওয়া যাবে না।

তবে কেউ কেউ আবার বলছেন, রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার মাধ্যমে বহু যোগ্য চিকিৎসক শিক্ষক যারা বছরের পর বছর স্বাস্থ্য সেক্টরে গুরত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন, সামান্য নিয়মনীতি পূরণ না করায় পদোন্নতি পাচ্ছিলেন না তারা পদোন্নতি পেয়েছেন। বিগত ছয় বছরে বিএমএ ও স্বাচিপ নেতারা এ ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

তবে বিএমএ মহাসচিব প্রফেসর ডা. এম ইকবাল আর্সলান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, বিগত সময়ে পিএসসির মাধ্যমে চিকিৎসকদের পদোন্নতি দেয়া হতো। পিএসসির পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতায় দেড় থেকে দুই বছর সময় লেগে যেতো।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে চিকিৎসকদের পদোন্নতি বলতে গেলে বন্ধই ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে ডিপিসি ও রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষকদের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শিক্ষক হিসেবে চাকরির অভিজ্ঞতার মেয়াদের ক্ষেত্রেই ছাড় দেয়া হয়েছে, অন্য কোনো বিষয়ে নয় বলে তিনি দাবি করেন।

অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব বলেন, আগে পিএসসির মাধ্যমে পদোন্নতি দেয়ার বিধান ছিল। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিপিসির মাধ্যমে দেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। যারা চিকিৎসকদের যথাযথভাবে পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন তাদের কাউকে রাখা হলো না। মন্ত্রণালয়ের আমলারা পেপারওয়ার্কের ভিত্তিতে পদোন্নতি দিলেন। এতে করে ভালো শিক্ষকের পদোন্নতি দেয়া কি আদৌ সম্ভব। সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনা পদ্ধতির মাধ্যমে আরেক দফা পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করা হলো।

তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি গল্পের উদাহারণ টেনে বলেন ‘সুবীর নামে এক পরিচিত যুবককে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি সার্টিফিকেট লিখে দিলেন, আমার সুবীর পড়তে জানে। রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনার মাধ্যমে চিকিৎসকের পদোন্নতি অনেকটা সেরকমই রাষ্ট্রপতি যেন সার্টিফিকেট দিলেন আমার চিকিৎসক শিক্ষকতা জানেন।’

আরো দেড় শতাধিক চিকিৎসকের পদোন্নতি শিগগিরই :
স্বাস্থ্য বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে আরো দেড় শতাধিক চিকিৎসকের পদোন্নতি হবে শিগগিরই। ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পদোন্নতি যোগ্য সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি চিকিৎসকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) বৈঠকের মাধ্যমে এ পদোন্নতি দেয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারাদেশে সহকারী সার্জন, মেডিকেল অফিসার, ডেন্টাল সার্জন, সহকারী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব), জুনিয়র কনসালটেন্ট (নিয়মিত), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চলতি দায়িত্ব) ও লেকচারার হিসেবে কর্মরত বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগ্যতমদের এ পদোন্নতি দেয়া হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য পাঁচ বছরের এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) অত্যাবশ্যক। চিকিৎসকদের তালিকা তৈরির সময় দেখা গেছে অনেক চিকিৎসক সঠিকভাবে এসিআর জমা দেননি।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত চিকিৎসকদের নামের তালিকার পাশে কোনো চিকিৎসক কোনো বছরের এসিআর জমা দিয়েছেন কিংবা জমা দেননি তার উল্লেখ করা হয়েছে। আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে তালিকাভুক্ত চিকিৎসককে স্ব স্ব উদ্যোগে এসিআর জমা দেয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন বিষয়ের শূন্যপদের চেয়ে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় পদোন্নতি প্রত্যাশী চিকিৎসকরা ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সচিব, সাংসদ ও রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) প্রভাবশালী চিকিৎসক নেতাদের মাধ্যমে গ্রুপিং লবিং শুরু করেছেন।

মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলানের কাছে সহকারী  অধ্যাপকদের পদোন্নতি উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন বিষয়ের খুব সম্ভবত ১৫৩টি শূন্য পদে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যোগ্য চিকিৎসকদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি (ডিপিসি) সভার মাধ্যমে আগামী এক মাসের মধ্যে পদোন্নতি দেয়া হতে পারে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

চিকিৎসকদের তদবির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নেতাদের কাছে চিকিৎসকরা তদবির করতেই পারেন। কিন্তু পদোন্নতির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ডিপিসির কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। স্বাস্থ্যসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এ কমিটির সভাপতি ও সদস্যসচিব। এ কমিটিতে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার স্বাস্থ্য, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তারা যাচাইবাছাই করে যোগ্যদেরই পদোন্নতি দিবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

এমইউ/একে/বিএ