বাস থেকে নেমেছিল কোথায় পায়েল?
চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকার বাসিন্দা ও রাজধানীর নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত সাইদুর রহমান পায়েল (২১) ঢাকায় আসার পথে বাস থেকে কোথায় নেমেছিলেন তা নিয়ে পরিবার ও পুলিশের বক্তব্যের ভিন্নতা পাওয়া গেছে।
নিহত পায়েলের স্বজনরা বলছে, ঢাকা যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন মদনপুর ক্যাসেল রেস্টুরেন্টের সামনে রাত ৪টার দিকে যানজটে পড়ে পায়েলকে বহনকারী বাসটি। এসময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাস থেকে সেখানে নেমেছিল পায়েল। কিন্তু বন্দর থানার ওসি কে এম শাহীন মণ্ডল জাগো নিউজের কাছে দাবি করেছেন, ‘পায়েল নারায়নগঞ্জে নামেইনি!’
পায়েলের মামা কামরুজ্জামান চৌধুরী জাগো নিউজকে জানান, গত শনিবার (২১ জুলাই) রাত ১০টার দিকে হালিশহরের বাসা থেকে বের হয় পায়েল। এক ঘণ্টা পর নগরীর এ কে খান গেট এলাকায় হানিফ পরিবহনের কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে সে ও তার এক বন্ধু ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। ওই বাসে তার সিট নম্বর ছিল এ-৩। যাওয়ার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর ক্যাসেল হোটেলের সামনে রাত ৪টার দিকে যানজটে পড়ে বাসটি। এসময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গাড়ি থেকে নেমেছিল পায়েল। আর তার বন্ধুটি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইতোমধ্যে যানজট কমলে বাস তাকে না নিয়েই চলতে শুরু করে।
এদিকে ভোর থেকে পায়েলের মোবাইলে কল দিচ্ছিলেন তার মা কোহিনূর বেগম। ভোর ৬টার দিকে পায়েলের সহপাঠী আকিবুর রহমান আদর (২১) ঘুম ভেঙে দেখে পায়েল সিটে নেই, মোবাইল ফোনটা পড়ে আছে। রিং হচ্ছে দেখে সে ফোনটি রিসিভ করে পায়েল গাড়িতে না থাকার কথা তার মাকে জানায়।
পরে পায়েলের খোঁজ না পেয়ে আমরা রোববার নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। সোমবার মুন্সিগঞ্জ থানার এক এসআই ফোন করে পায়েলের মরদেহ পাওয়ার খবর জানায়।
ঘটনার তিনদিন পেরিয়ে গেলেও পায়েলকে কারা বা কেন হত্যা করেছে তার কোনো উত্তর খুঁজে পায়নি পুলিশ। এ নিয়ে নারায়নগঞ্জের বন্দর থানা ও মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন ভিন্ন কথা।
পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়নগঞ্জের বন্দর থানার ক্যাসেল হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে পায়েলের নামার কথা বলা হলেও বন্দর থানার ওসি কে এম শাহীন মণ্ডল জাগো নিউজের কাছে দাবি করেছেন, ‘পায়েল নারায়নগঞ্জে নামেইনি!’
মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক পুলিশ পরিদর্শকের বরাত দিয়ে ওসি জানান, পায়েল যে জায়গায় নেমেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করছে, সেটি কোনো বাসস্টপেজ নয়। আশপাশের অনেকের সঙ্গে কথা বলে ওই দিন রাতে গাড়ি থেকে কেউ নেমেছে এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
ওসি কে এম শাহীন মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে দেখেছি, ওই দিন রাতে আমার থানা এলাকায় নিহত পায়েল নামেননি। আর যেখানে তার মরদেহ পাওয়া গেছে তা আমার থানা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। যতদূর জেনেছি ছেলেটি কুমিল্লার দিকে নেমেছে হয়তো।’
এসময় তিনি ঘটনা যেহেতু তার এলাকায় নয়, তাই নিহতের পরিবারের জিডি নেননি বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার ওসি হারুনুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে সোমবার সকালে আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভাটেরচর সেতুর নিচে ফুলদী নদীতে ভাসমান অবস্থায় এক তরুণের মৃতদেহ উদ্ধার করি। মৃত যুবকের পকেটে একটি মানিব্যাগ ছিল। এতে লন্ড্রির রসিদ এবং জন্ম নিবন্ধন নম্বর ছিল। এগুলোর ভিত্তিতে নিহত যুবকের আত্মীয়ের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।’
ওসি হারুনুর রশিদ আরও বলেন, ‘নিহতের পরিবার হানিফ পরিবহনের সুপারভাইজার জনিকে এখানে নিয়ে এসেছিল। তিনি নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, ঘটনার দিন ভোররাত সাড়ে ৪টায় বাসটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মদনপুর ক্যাসেল হোটেলের সামনে যানজটে পড়ে। তখন টয়লেটের প্রয়োজনে পায়েল বাস থেকে নামেন।’
পায়েল বাস থেকে নামেন নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন মদনপুর ক্যাসেল রেস্টুরেন্টের সামনে কিন্তু তার মরদেহ উদ্ধার করা হয় মুন্সিগঞ্জের গজারীয়া থানাধীন ভাটেরচর সেতুর নিচে ফুলদী নদী থেকে
হানিফ পরিবহনের (নং ৯৬৮৭) সুপারভাইজার জনির বরাতে ওসি জানান, ‘চট্টগ্রামের এ কে খান সখিনা কাউন্টার থেকে রাত ১০টায় রওনা করেন তারা। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ক্যাসেল রেস্টুরেন্টের কাছে যানজটে পড়ে। তখন পায়েল বাস থেকে নেমে পড়ে। জ্যাম ছেড়ে রাস্তা ফাঁকা হলে গাড়ি দ্রুত ছেড়ে দেয়। ফলে সে গাড়িতে উঠতে পারেনি।’
কেন প্রাণ দিতে হলো পায়েলকে?
ফুলদী নদী থেকে পায়েলের মরদেহ উদ্ধারে অংশ নেয়া গজারিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আসাদুজ্জামান তালুকদার জাগো নিউজকে জানান, মরদেহ উদ্ধারের সময় নিহত পায়েলের নাক ও মুখে রক্ত ছিল। আর গলার ডান পাশ ও পেটের দুই পাশে কালো দাগ ও ক্ষত দেখা গেছে।
গজারিয়া থানার ওসি হারুনুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছেলেটিকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আমরা যখন মরদেহ উদ্ধার করি তখন মরদেহ ফুলে গিয়েছিল। তবে তার নাক-মুখে রক্তের আলামত পাওয়া গেছে। মনে হচ্ছে মাথায় ভারী কিছুর আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে।’
প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা বা কোনো লুটেরার দল এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। কেননা মরদেহ উদ্ধারের পর তার সঙ্গে যে মানিব্যাগটি পাওয়া গেছে তাতে টাকা-পয়সাসহ বাকি সব কিছু ঠিকই ছিল। এমনকি হাতের দামি ঘড়িটিও সঙ্গেই পাওয়া গেছে। লাশ উদ্ধারের পর থেকেই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। ধারণা করছি অন্য কোথাও হত্যার পর ঘাতকরা রাতের অন্ধকারে ব্রিজে গাড়ি থামিয়ে নদীতে লাশটি ফেলে পালিয়েছে।’
নিহত সাইদুর রহমান পায়েল নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ৫ম সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকার আই ব্লকে তার বাসা। তবে তাদের গ্রামের বাড়ি সন্দীপের পূর্ব হরিশপুর গ্রামে। পায়েল ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে বন্ধুদের নিয়ে ভাড়া থাকতেন। কাতার প্রবাসী গোলাম মাওলার দুই সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে পায়েল। আর একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে।
এমবিআর/জেআইএম