ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

রোগীদের জিম্মি করে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক | চট্টগ্রাম | প্রকাশিত: ০৩:৪১ পিএম, ০৩ জুলাই ২০১৮

নিজেরা দোষ করে সে দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে সুকৌশলে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করা যেন চট্টগ্রামে এখন চিকিৎসা ব্যবস্থায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠে। কিন্তু প্রতিটি ঘটনার পর দোষী ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা উঠলেই রাস্তায় নেমে পড়ছেন চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘তাদের হয়রানি করা হচ্ছে’। প্রতিবাদে তারা রোগীদের জিম্মি করে কর্মবিরতি পালন করেন।

সাম্প্রতি চিকিৎসকের অবহেলায় সাংবাদিক কন্যা রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় দোষিদের শাস্তি দাবি করায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল ইকবাল ঘোষণা দিয়েছেন, ‘চিকিৎসকরা সাংবাদিকদের চিকিৎসা করবেন না।’ এ ঘোষণার মাধ্যমে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সব চিকিৎসককে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ)।

যদিও ২০১৬ সালে এমনই এক ঘটনায় অনৈতিক প্রভাব বিস্তার কিংবা চাপ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখাকে সতর্ক করেন আদালত।

ctg2

২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি বিকেল থেকে হঠাৎ করে সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপারেশনসহ সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখেন চিকিৎসকরা। পাশাপাশি ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগী দেখা বন্ধ করে দেন তারা। এতে সাধারণ রোগীরা দুর্ভোগে পড়েন।

চট্টগ্রামে রোগীর স্বজনদের করা দুটি মামলায় ২০১৬ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘রোগীদের জিম্মি করার অধিকার চিকিৎসকদের সংগঠন সংরক্ষণ করে না। চিকিৎসকেরা অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলবে না- এটি গোষ্ঠীগত দাম্ভিকতা। গোষ্ঠীগত স্বার্থে অপরাধীকে আড়াল করা যাবে না।’

আদালতের আদেশে আরও বলা হয়, ‘চিকিৎসকরা রাষ্ট্রের আইনের ঊর্ধ্বে নন। রোগীকে জিম্মি করে মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারকে অগ্রাহ্য করা রাষ্ট্রে বিদ্যমান আইনের অনেকগুলো ধারায় বিচার্য অপরাধ। এই কাজের সঙ্গে সংখ্যায় যত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট থাকুক না কেন, কিংবা বাদীকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রকাশ্যে সমাবেশ করে হুমকি প্রদানকারীর যত বড় পরিচয় থাকুক না কেন, তারা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন লঙ্ঘনকারী অপরাধী।’

‘একটি পেশাজীবী সংগঠনের কার্যক্রম হওয়া উচিত তার পেশাকে আরও উন্নত করা এবং পেশাজীবী কেউ অপরাধ করলে সে বিষয়ে প্রতিকার করে পেশাকে আরও জনকল্যাণমুখী করার প্রচেষ্টা চালানো।’

ctg2

চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল বেসরকারি হাসপাতাল চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে জীবিত মেয়ে শিশু চুরি করে মৃত ছেলে শিশু দেয়া এবং জালিয়াতি করে ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।

২০১৭ সালের ১১ মে এক অনুষ্ঠানে চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছিলেন, ‘কোনো রোগীকে জিম্মি করে দাবি আদায় করা কখনও চিকিৎসকদের কাজ হতে পারে না। কালো ব্যাচ ধারণ করতে পারেন, প্রয়োজনে আমাকেও ঘেরাও করে রাখতে পারেন, তবুও চিকিৎসা বন্ধ করবেন না।’

কিন্তু আদালতের আদেশ বা মন্ত্রীর নির্দেশ কোনোটাই আমলে নিচ্ছেন না চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার নেতারা। সর্বশেষ গতকাল (২ জুলাই) সোমবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মূল ফটকের সামনের দুই ঘণ্টা সড়ক অবরুদ্ধ রাখে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। এতে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী ও চিকিৎসা নিতে আসা রোগী-স্বজনরা। পরে পুলিশি হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

এসময় সড়ক অবরোধে আটকা পড়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরাও দুর্ভোগে পড়েন। বিএমএর চাপে শতাধিক সিনিয়র-জুনিয়র ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মসূচিতে অংশ নেন। ফলে ব্যাহত হয় হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম।

ctg2

ভুল চিকিৎসায় নিহত একমাত্র সন্তান রাইফার লাশ হাতে সমকালের জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক রুবেল খান।

রোগীদের জিম্মি করে চিকিৎসক নেতাদের এধরনের কর্মসূচি নতুন নয়। বিভিন্ন সময় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগ উঠলেই রোগী ও তাদের স্বজনদের জিম্মি করে কর্মবিরতি পালন করেছেন তারা।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল ‘সার্জিস্কোপ’ প্রসব পরবর্তী সময়ে মারা যান মেহেরুন্নেসা রীমা (২৫) নামের এক গৃহবধূ। রীমা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির ছোট ভাইয়ের মেয়ে। চিকিৎসকের অবহেলায় রীমার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে ওইদিন রাতে সার্জিস্কোপ হাসপাতাল ভাঙচুর করে নিহতের স্বজনেরা। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা সিদ্দিকী রোজি ও তার স্বামী মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন রীমার বাবা খায়রুর বাশার।

মামলটিকে ‘হয়রানিমূলক’ মন্তব্য করে এর প্রতিবাদে ২০১৬ সালের ২০ জানুয়ারি বিকেল থেকে হঠাৎ করে সব বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপারেশনসহ সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখেন চিকিৎসকরা। পাশাপাশি ব্যক্তিগত চেম্বারেও রোগী দেখা বন্ধ করে দেন তারা। এতে সাধারণ রোগীরা দুর্ভোগে পড়েন। কয়েকদিন স্থায়ী ছিল এ ধর্মঘট।

এর আগে ২০১২ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের মলদ্বারে অস্ত্রোপচারের পর সুই রেখে সেলাই দেয়ার ঘটনায় ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ডা. সুরমান আলী ও জাকির হোসেন নামে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করেন ওই ছাত্রের মা দেলোয়ারা বেগম। এ মামলাকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ে কর্মবিরতি পালন করেছিল চিকিৎসকরা। এতে ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ লোকজন।

ctg2

সোমবার (২ জুলাই) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মূল ফটকের সামনের সড়ক ২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ রাখে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল বেসরকারি হাসপাতাল চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে জীবিত মেয়ে শিশু চুরি করে মৃত ছেলে শিশু দেওয়া এবং জালিয়াতি করে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া ঘটনাটি আলোরণ তুলে সারা দেশ ব্যাপি। ওই সময় সাংবাদিকদের শক্ত অবস্থানের কারণে আইনশৃঙ্খণা বাহিনীর সহায়তায় নোয়াখালীর রোকসানা আকতার তার নবজাতক কন্যাকে ফিরে পান। এর পরপরই ঘটে আরেক বেসরকারি পিপলস হাসপাতালে জমজ নবজাতকের একটি অভিভাবকের অগোচরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার মত ঘটনা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন,‘একজন চিকিৎসক তার শত্রু কেউ চিকিৎসা দিতে বাধ্য। এটা তারা পেশার মৌলিক বৈশিষ্ট। যে কোনো পেশায় কাজের ক্ষেত্রে ভুল যেমন হতে পারে, তেমনি সেই ভুলের শাস্তির ব্যবস্তা করার ক্ষমতাও রাস্টের আছে। এ ক্ষেত্রে রোগীদের জিম্মি করে ঢাল বানিয়ে অপরাধীকে রক্ষার চেষ্টা চিকিৎসা সেবার মত পেশায় মানায় না। তাদের উচিত সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস রাখা।’

সনাক সদস্য ও টিআইবি'র সাধারণ পর্ষদ সদস্য প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার জাগোনিউজকে বলেন, ‘পেশাজীবী সংগঠানগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে, তার পেশাজীবীদের পেশাগত মানের উৎকর্ষ সাধন এবং তাদের সমস্যা সমাধান করার জন্য আন্দোলন–সংগ্রাম করা। কিন্তু বর্তমানে পেশাজীবী সংগঠনগুলো এই দায়িত্ব পালন করছে না। বরং তারা গোষ্ঠীগত স্বার্থে অপরাধীকে আড়াল করছে। প্রায়াসই তারা জনগণের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থানে চলে যাচ্ছে। এটা পেশাগতভাবে তাদের সম্মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণকে জিম্মি করে নয়, বরং সমস্যার মূলে গিয়ে, সংকট চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব পেশাজীবী সংগঠনের। কথায় কথায় অচল করে দেয়া, বন্ধ করে দেয়া, জনগণকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এটা অগ্রহণযোগ্য এবং পেশাশক্তি প্রদর্শনের সমতুল্য। পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে এ বিএমএ এ ধরনের কাজ না করলে আমরা খুশি হব।’

এমবিআর/জেআইএম

আরও পড়ুন