অভিযুক্ত ২২, দায়মুক্তি পাচ্ছেন হাসনাত করিম?
গুলশানের হলি আর্টিসানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২২ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিচ্ছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের তদন্ত দল। তবে অতি আকাঙ্ক্ষিত এই অভিযোগপত্রে হাসনাত করিমের নাম থাকা, না থাকা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, হামলায় হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অভিযোগপত্রে তার নাম নাও থাকতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদনে সেই রাতে (১ জুলাই) রেস্টুরেন্টের ভেতর জঙ্গিদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলাসহ তার সন্দেহজনক ভঙ্গিমা ‘পরিস্থিতির শিকার’ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘হামলার ঘটনায় অস্ত্রদাতা, জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা ও অর্থ বিনিয়োগকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের অভিযুক্ত করে ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হবে।’
তবে চার্জশিটে কার কার নাম থাকছে সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই আর্টিসানে জঙ্গিদের হামলায় ১৭ বিদেশি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জন নিহত হন। জীবিত জিম্মিদের উদ্ধারে ২ জুলাই হলি আর্টিসানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নিহত হন ছয় জঙ্গি। অভিযানে এক জাপানি ও দু'জন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনার পর ৪ জুলাই গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। মামলার তদন্তভার দেয়া হয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে।
সিটিটিসি সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র-বোমা সংগ্রহ, সমন্বয়, জঙ্গিদের আশ্রয়দাতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ২২ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অভিযোগপত্রে তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ২২ জনের মধ্যে হামলায় অংশগ্রহণকারী পাঁচ জঙ্গিসহ ১৪ জন নিহত হয়েছে। মামলার সাত আসামি কারাগারে এবং দু’জন পলাতক রয়েছে।
সিটিটিসি আরও জানায়, গুলশান হামলার রাতে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর দায় স্বীকার করলেও তদন্তে আইএস’র অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। হামলাকারীদের দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী ‘নব্য জেএমবি’র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যা থাকছে অভিযোগপত্রে
গুলশান হামলার অভিযোগপত্রে যে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১৪ জন গুলশানসহ বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় পরিচালিত অভিযানে নিহত হয়েছে। তারা হলেন- তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ার জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।
বাকি পাঁচজন সেনাবাহিনীর অপারেশন থান্ডারবোল্টে নিহত হন। তারা হলেন- রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
কারাগারে থাকা সাত আসামি হচ্ছেন- রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাতকাটা সোহেল মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ ও আবদুস সামাদ ওরফে মামু। এছাড়া পলাতক দুই আসামি হলেন- শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন।
মূল পরিকল্পনাকারী
অভিযোগপত্রে তামিম আহমেদ চৌধুরীকে গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান এই নাগরিক গুলশান হামলার দিন মিরপুরের একটি আস্তানায় বসে দুই সহযোগীসহ হামলার পুরো বিষয়টি অনলাইনের মাধ্যমে দেখভাল করেন।
২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তুরস্ক হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি। এরপর প্রথম দিকে জুনুদ আল তাওহিদ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরির চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা আব্দুস সামাদ মামু, মামুনুর রশীদ রিপন ও সরোয়ার জাহানসহ নব্য জেএমবি নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গঠন করেন।
২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশের জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ মারা যান তামিম।
হামলার প্রশিক্ষণ
হামলার প্রশিক্ষক হিসেবে অভিযোগপত্রে মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে ‘মেজর মুরাদ’কে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া মেজর। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, গাইবান্ধা ও বগুড়ার বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় মেজর মুরাদ আর্টিসানের হামলাকারীদের শারীরিক ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেন তিনি।
সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ চলে ২৮ দিন। প্রশিক্ষণ শেষে দলটিকে ঢাকায় এনে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় রাখা হয়। সেখান থেকে বের হয়ে হামলায় অংশ নেয় তারা। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগরে সিটিটিসির জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন জাহিদ। এছাড়া রায়হান কবির ওরফে তারেক নামে আরেক নিহত জঙ্গির বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
খরচ ও অর্থ সংগ্রহ
অভিযোগপত্রে গুলশানের ওই হামলাকে একটি ‘লো কস্ট টেররিজম’ ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হামলার খরচ দেখানো হয়েছে আট থেকে সর্বোচ্চ নয় লাখ টাকা। মূল ধারার জেএমবি থেকে নব্য জেএমবি’তে যোগ দেয়ার সময় তারা ব্যক্তিগত অর্থ সংগঠনে নিয়ে আসেন। ওই টাকা দিয়েই হামলার খরচ চালানো হয়।
হামলার স্পট ‘হলি আর্টিসান’ কেন?
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, হামলার তিন মাস আগে এপ্রিলে ঢাকায় বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে নব্য জেএমবি। তারা এমন একটি রেস্টুরেন্ট খুঁজতে থাকে যেখানে দেশি ও বিদেশিরা একসঙ্গে থাকবেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কাভারেজ, বিদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য বেছে নেয়া হয় হলি আর্টিসান।
আশ্রয়দাতা
আর্টিসানে হামলাকারীদের আশ্রয়দাতা ও অন্যতম অর্থদাতা হিসেবে তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, হামলার আগে বিভিন্ন সময় নব্য জেএমবির সদস্যদের নিজ বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন তানভীর কাদেরী।
তিনি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই-ব্লকের ছয় নম্বর সড়কের টেনামেন্ট-৩ এর ফ্ল্যাট-এ/৬ ভাড়া নেন। পাঁচ হামলাকারী এখানেই অবস্থান করেন। তার বাবার নাম বাতেন কাদেরী। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুর এলাকায় সিটিটিসির এক অভিযানে নিহত হন তিনি।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
অভিযোগপত্রে নিহত মারজান ও বাশারুজ্জামান চকলেটকে তামিম চৌধুরীর হামলার পরিকল্পনার বাস্তবায়নকারী এবং তামিমের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে তাদের তামিমের ‘বিশ্বস্ত সহচর’ উল্লেখ করা হয়। বলা হয়েছে, গুলশান হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ হামলাকারীর একই রঙের গেঞ্জি-ট্র্যাক সুট ও জুতা কেনার কাজটিও করেছিলেন বাশারুজ্জামান।
অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহ
অভিযোগপত্রে সোহেল মাহফুজ, সাগর, বড় মিজান ও ছোট মিজানকে অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ছোট মিজান গুলশান হামলায় অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহে মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজানের ভূমিকা ছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। পুরনো জেএমবির সদস্য ছোট মিজান নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় দায়িত্বশীল পদে কাজ করেন। তার কাজ ছিল সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাচার করে বিভিন্ন আস্তানায় পৌঁছে দেয়া।
২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সিটিটিসির এক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বাশারের সঙ্গে নিহত হন ছোট মিজান। এছাড়া অস্ত্র সরবরাহক হিসেবে গ্রেফতার হওয়া হাদিসুর রহমান সাগরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
হামলাকারীদের রিক্রুটমেন্ট
গুলশান হামলার অপারেশনে অংশ নেয়া রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েলকে হামলার জন্য প্রাথমিকভাবে সরবরাহ করেছিলেন মামুনুর রশীদ রিপন। অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া অভিযোগপত্রে শরিফুল ইসলাম খালিদ নামে আরেক পলাতক নব্য জেএমবি নেতাকে পরিকল্পনায় সহযোগিতা, বাস্তবায়ন ও হামলাকারী সরবরাহকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপারেশন পরিচালনা
গুলশানের আর্টিসানে মূল অপারেশনে অংশ নেয়া পাঁচজনের অভিযোগপত্রে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে আবু রাহিক আল বাঙালিকে দলনেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর্টিসানের ভেতরের সব কিছু রোহানের নির্দেশনায় পরিচালিত হয়।
হাসনাত করিমের ভূমিকা
গুলশান হামলার দিন জীবিতদের উদ্ধারের পর থেকে গোয়েন্দা হেফাজতে রাখা হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে। গুলশান হামলার দু'দিন পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে হাসনাত করিমের সঙ্গে জঙ্গিদের নিশ্চিন্তে কথা বলার ছবি প্রকাশ হলে তার সংশ্লিষ্টতার গুঞ্জন ওঠে।
গুলশান হামলার এক মাস পর গুলশান এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। কয়েকবার জামিন আবেদন করলেও দুই বছর ধরে তিনি কারাগারে আছেন। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই হামলায় হাসনাত করিমের সংশ্লিষ্টতা পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা।
হামলার বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এটি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ওই ষড়যন্ত্রের মাত্রা এতটাই ব্যাপক ছিল যে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আরও অনেকে জড়িত ছিল। তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কে, কোন দায়িত্ব পালন করেছে, ফিজিক্যাল এভিডেন্স, কেমিক্যাল রিপোর্ট, এক্সপার্ট ওপিনিয়ন ইত্যাদির কারণে তদন্ত একটু সময়-সাপেক্ষ হয়েছে।
তবে প্রত্যাশা করছি ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারব। হামলা সম্পর্কিত সব তথ্যপ্রমাণ চার্জশিটে থাকবে যাতে ভবিষ্যতে এই মামলার তদন্ত ও বিচার দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকে।
সর্বশেষ তদন্তের অবস্থা এবং চার্জশিট প্রদান প্রসঙ্গে শনিবার সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ২২ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ১৪ জন বিভিন্ন সময়ে আমাদের পরিচালিত অভিযানে মারা গেছেন। বাকি আটজনের বিরুদ্ধে আমরা চার্জশিট দেব। এর মধ্যে ছয়জন গ্রেফতার রয়েছেন। বাকি দু’জন এখনও পলাতক।’
‘গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে’- বলেও জানান তিনি।
হাসনাত করিম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা এখন পর্যন্ত চার্জশিট আদালতে উপস্থাপন করিনি সেহেতু কার কার নাম চার্জশিট থাকছে এবং কে কে বাদ পড়ছেন, তাদের নাম এখন প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। এটি আইন বহির্ভূত বিষয় হবে।
এআর/এমএআর/এমআরএম/আরআইপি