চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে হেপাটাইটিস-ই, আতঙ্ক
চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর ও আশপাশের এলাকায় পানিবাহিত রোগের পাশাপাশি হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। গত তিন মাসে পাঁচ শতাধিক মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন অন্তত দশজন। তবে সরকারিভাবে তিনজনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হয়েছে। রোগের প্রকোপে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে; বর্তমানে তাদের অনেকেই ফিল্টার পানি ও বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি কিনে পান করছেন।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে অন্যান্য পানিবাহিত রোগের সঙ্গে হেপাটাইটিস-ই সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা থেকে আসা টিম এবং এখানকার প্যাথলজিকাল সেন্টারে হালিশহর এলাকার যত রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে সেখানে প্রায় সবগুলোতেই হেপাটাইটিস-ই পাওয়া গেছে।’
গত মার্চ মাসের শুরুতে হালিশহরে পানিবাহিত রোগে তিন শতাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। রমজানে কয়েকজনের মৃত্যু হলেও স্বাভাবিক বিবেচনায় তা আলোচনায় আসেনি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে আবারও ওই এলাকায় হেপাটাইটিস-ইসহ টাইফয়েড, জন্ডিস ও ডায়রিয়ার মতো বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে ইয়াসির আরাফাত (২৮), শাহেদা মিলি (৪০) ও আশিকুল রিসাত (১৮) নামের তিনজনের মৃত্যুর খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় চরম আতঙ্ক দেখা দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাস কয়েক আগে চট্টগ্রামের সিডিএ আবাসিক এলাকা এবং হালিশহর হাউজিং এস্টেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট ১১ জনের হেপাটাইটিস-ই পরীক্ষা করার জন্য স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয় এবং ১১ জনের প্রত্যেকেরই হেপাটাইটিস-ই ধরা পড়ে। এরপর ওই এলাকার ওয়াসার পানি পরীক্ষা করে সেখানেও হেপাটাইটিস-ই এর জীবাণু ধরা পড়ে।’
জান্নাতুর নাঈম নামে এক গৃহবধূ বলেন, ‘হেপাটাইটিস-ই এখন হালিশহরে আতঙ্কের নাম। একদিকে জলাবদ্ধতা অন্যদিকে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি ও পানির লাইন লিকেজ হয়ে ময়লা-আবর্জনা প্রবেশ করায় হালিশহর এলাকায় এ রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে এক মাসে অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।’
এদিকে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দেয়ার কারণ অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) স্বাস্থ্য বিভাগের তিন সদস্যের একটি দল মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে একজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে দুইজন স্বাস্থ্যকর্মী তদন্ত কাজ শুরু করেন।
গত সোমবার ওই এলাকার অন্তত ২৫টি বাসা থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করার পর মঙ্গলবার আরও পাঁচটি বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা।
হালিশহরের এ, বি, আই, কে ও এইচ ব্লকের বিভিন্ন বাসার ওয়াসার রিজার্ভ পানি ও লাইনের পানির নমুনা নিয়ে যায় ওয়াসার কর্মীরা। পানির নমুনা পরীক্ষার ফলাফল ৪৮ ঘন্টা পর জানানো হবে বলে জানিয়েছেন ওয়াসার গবেষকরা।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ক্যামিস্ট মিলন চক্রবর্ত্তী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর আগেও আমরা নমুনা নিয়ে গেছি। কিন্তু কোন ধরনের জীবাণু পাওয়া যায়নি। জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া একজনের বাসায়ও গিয়েছি আমরা। ওই বাসায় ওয়াসার সংযোগ নেই এবং সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে আসছিল পরিবারটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও হালিশহর এলাকার এই পানির নমুনা পরীক্ষা করানো হয়েছে। কিন্তু সেখানেও কিছু মেলেনি।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী আজিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওয়াসার পানির মাধ্যমে কোথাও ভাইরাস ছড়ায়নি বলে আমার ধারণা। তারপরও আমরা এসব নমুনা গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের ল্যাবে পরীক্ষা করবো। যারা বাসায় রিজার্ভ ট্যাংকে ওয়াসার পানি জমান, জলাবদ্ধতার কারণে তাদের পানিতে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।’
এদিকে মঙ্গলবার (২৬ জুন) দুপুর একটায় হালিশহর বি ব্লকের দুই নাম্বার রোডের ১৬ লাইনের ১৯ নম্বর বাসা থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করতে যান ওয়াসার প্রকৌশলী মো. মামুন। তিনি জানান, মঙ্গলবার পাঁচটি বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই বাড়ির মালিক হাছিনা বেগম বলেন, হালিশহরের পাঁচ শতাধিক মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে চসিকের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, হালিশহরে তিনজনের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে আমাদের একজন চিকিৎসকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের দল মঙ্গলবার থেকে কাজ শুরু করেছে। তারা মারা যাওয়া তিনজনের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন। তদন্ত দল বুধবার প্রতিবেদন জমা দিতে পারে। তারপরই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
এদিকে পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয় জরুরি ভিত্তিতে ১০টি নির্দেশনা দিয়েছে।
নির্দেশনাগুলো হলো- বিশুদ্ধ পানি পান ও ব্যবহার নিশ্চিত করা। পানি ৩০ মিনিট ফুটিয়ে ফিটকিরি ব্যবহার করে অথবা পাঁচ লিটার পানিতে একটি পানি বিশুদ্ধকরণ টেবলেট দিয়ে আধ ঘণ্টা থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করা, হোটেল বা দোকানের পানি খাওয়া বন্ধ করা। এছাড়া রাস্তায় খোলা জায়গার শরবত বা খাবার খাওয়া বন্ধ করা, এলাকায় কারও চোখ হলুদ হলে, ডায়রিয়া হলে বা তিনদিনের বেশি জ্বর থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। হালিশহর বিডিআর মাঠ থেকে বিশুদ্ধকরণ টেবলেট সংগ্রহ করা।
অন্য নির্দেশনাগুলো হচ্ছে- গর্ভবতী নারীর চোখ হলুদ হলে স্থানীয় হাসপাতালে যোগাযোগ করা, বাসার ছাদে বা পানির নিচে সংরক্ষিত পানির ট্যাংক চারমাস পর পর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করা, খাবারের আগে ও মলত্যাগের পরে হাত অন্তত ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে পরিষ্কার করা, হাতের নখ ছোট রাখা, খালি পায়ে বাথরুমে না যাওয়া এবং বাথরুমে আলাদা জুতা ব্যবহার করা, বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণের পাত্রটির নিচের অংশ নিয়মিত পরিষ্কার করা এবং ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা, পাতলা পায়খানা হলে ওরস্যালাইন ও ঘরের তৈরি চিনি ও লবণ মিশ্রিত শরবত বেশি বেশি পান করা এবং আতঙ্কিত না হয়ে বিশুদ্ধ খাবারের পানি খাওয়া ও ব্যবহার করা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওয়াসার পানি নিয়ে প্রশ্ন থাকা, বাসার অপরিস্কার পানির ট্যাংক, ভূ-গর্ভস্থ পানির সমস্যা থাকা, পুকুর-ডোবার পানি পান করা এবং বর্ষায় জলাবদ্ধতা হয়ে সুপেয় পানির সঙ্কট থাকাসহ নানা কারণে তারা বিশুদ্ধ পানি পান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হালিশহরের বাসিন্দারা। তাই ওই এলাকায় পানিবাহিত রোগের সমস্যাটি দেখা দিচ্ছে।
এমবিআর/পিআর