মাইয়্যারে মাটিচাপা দিয়া ঈদ করমু ক্যামনে!
‘আমি বাজান অপারেশনের রোগী। আগে প্রতিদিন রিকশা চালাইতাম। অপারেশন করার পর থেইক্যা তেমন রিকশা চালাইতে পারি না। আমার মাইয়্যাডার ওপর ভরসা কইর্যা চলতো পুরো পরিবার। আজ রাইতে সেহরি খাওয়ার সময় হেয় বলছিল, দু’দিন পর বেতন-বোনাস পাইব্যো। তারপর একসঙ্গে বাড়ি যামু। সর্বনাশা বাস আমার মাইয়্যাডারে মাইর্যা ফালাইলো। মাইয়্যারে মাটিচাপা দিয়া ঈদ করমু ক্যামনে!’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে একরাশ হতাশার অশ্রুজলে বুকফাটা আর্তনাদে বলছিলেন অসহায় বাবা ইসমাইল হোসেন। সড়ক দুর্ঘটনায় ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মেয়ে মারা যায় আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুর আড়াইটার দিকে। মেয়ের মৃত্যুর কথা শুনে বার বার তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এমন দৃশ্য দেখে শোকার্ত হয়ে পড়ে জরুরি বিভাগের পরিবেশ।
রাজধানীর লালমাটিয়ার একটি বাসায় থাকতো জান্নাত আক্তার (১২)। প্রতিদিনের মতো মিরপুর-১০ নম্বর রোড এলাকায় তাজ ফ্যাশন নামে একটি গার্মেন্টে যাচ্ছিলেন হেঁটে। সঙ্গে খালাতো বোন লাবণী আক্তার (১৩) ও সহকর্মী রাজিয়া বেগম (১৪)। তারাও একই কারখানায় কাজ করে।
এ সময় এলাকার বড় মসজিদ সংলগ্ন স্থানে এভিনিউ এলাকায় আসলে পেছন থেকে দ্রুতগামী ইটিসি নামে একটি যাত্রীবাহী গণপরিবহন তাদের ধাক্কা দেয়। ধাক্কায় জান্নাতের কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত বাসটির চাকার নিচে চলে যায়। ফলে তার কোমর ও দুই পায়ের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে যায়। সেই সঙ্গে কাঁধ থেকে ডান হাতের বিভিন্ন অংশে আঘাত পায় খালাতো বোন লাবণীও।
পরে তাদের উদ্ধার করে সকাল ৮টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। সেখানে প্রায় ৬ ঘণ্টা চিকিৎসা শেষে কর্তব্যরত চিকিৎসক দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে অসহায় বাবা ইসমাইলের। তিনি বার বার মেয়ের কথা মনে করে বুকফাটা আর্তনাদ করছিলেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক আব্দুল হালিমকে আটক করেছে পল্লবী থানা পুলিশ।
নিহত জান্নাতের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের ঘোষারহাট এলাকার হানিফাবাড়ি কান্দি গ্রামে। তারা তিন বোন এক ভাই। নিম্নবিত্ত পরিবারের ভরণ-পোষণ রিকশাচালক বাবা ইসমাইলের একার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ৬ মাস আগে পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ঢাকা এসে গার্মেন্টে চাকরি নেই ১২ বছরের কিশোরী জান্নাত। এরপর থেকে অসুস্থ পরিবারের মা এবং তিন ভাই-বোনের জন্য টাকা পাঠাত। বাবাকে নিজের কাছে রেখে চিকিৎসাও করতো মেয়ে জান্নাত।
কিন্তু আজ সড়ক দুর্ঘটনায় জান্নাতের প্রাণ কেড়ে নেয়ায় চারদিকে অন্ধকার দেখছেন রিকশাচালক বাবা। বাবা বলছিলেন মেয়ে দুর্ঘটনায় মরেনি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। এই বিচার কে করবে? তার পরিবার কিভাবে চলবে বলছিলেন।
তিনি বলেন, সে যা বেতন পাইতো তাই দিয়্যা পুরো মাস চলতাম। আবার বাড়িতেও পাঠাইতাম। আমার চিকিৎসার খরচও চালাইতো সে। এহন আমি কীভাবো চলবো। তারে নিয়া দু’দিন পর বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। সে কইলো শনিবারে বেতন বোনাস পাইলে এক সঙ্গে বাড়িতে যামু। এহন তার মরদেহটা আমি বাড়িতে নিমু ক্যামনে। আমি একা একা যামু ক্যামনে বাজান!
দুর্ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী সহকর্মী রাজিয়া জাগো নিউজকে জানান, তারা তিনজনই রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সে সময় রাস্তায় তেমন কোনো গাড়িও ছিল না। হঠাৎ দ্রুত গতির ইটিসি বাসটি এসে তাদের সঙ্গে থাকা জান্নাতকে ধাক্কা দেয়। ফলে সে নিচে পড়ে গেলে বাসটির চাকা তার দু’পায়ের ওপর দিয়ে উঠে কোমরে চাপা দিয়ে চলে যায়। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় বাসচালক ও গাড়িটি আটক করে পুলিশ।
পল্লবী থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) খন্দকার সাইদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এ ঘটনায় বাসটি ও তার চালক আব্দুল আলিম থানায় আটক আছে। নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেকের মর্গে রাখা হয়েছে এবং তদন্ত রিপোর্টের পর প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এসএইচ/এমআরএম/জেআইএম