ছবি দিয়েন না, সন্তানেরা কষ্ট পাবে!
>>বৃদ্ধাশ্রমে যারা আসেন, মরণের পরেই তারা মুক্তি পান
>>স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেরা বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে
>>বড় মেয়ের বাড়িতে গেলাম, সেখানেও ঠাঁই হল না
‘মুখের ছবি দিয়েন না, নিউজে নামও দিয়েন না। ছেলে-মেয়েরা দেখলে বড় কষ্ট পাবে। বিরক্তও হতে পারে। বাঁচব-ই বা আর কয়দিন! মরে গেলেই তো বাঁচি। বেঁচে যায় গর্ভের সন্তানেরাও।’
নিজেকে আড়াল রেখে বৃদ্ধাশ্রমের এক মায়ের সন্তানদের আগলে রাখার চেষ্টা এমন। বৃদ্ধাশ্রমে মা! এমন ছবি বা নাম দিয়ে নিউজ হলে সন্তানেরা বিরক্ত হতে পারে। সন্তানদের সেই ‘বিরক্তি’ অসহায় মায়ের কাছে বড় কষ্টের হবে।
বলছিলেন, ‘ছেলেমেয়ে কষ্ট পেলে আমিও যে কষ্ট পাবো। বৃদ্ধাশ্রমে আছি! ভালোই তো আছি। অযথা আমার কারণে ওরা কষ্ট পাবে কেন? ওরা এখন বড় অফিসার। ছেলেমেয়েদের বন্ধু-কলিগরাও হয়ত জানতে চাইবে আমার কথা, থাক না। জীবনের শেষবেলায় এসে আর ওদের কষ্ট বাড়াবো কেন?’
গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে মিনিট ৪০-এর মতো আলাপ। আশ্রমের বাসিন্দা মিরা চৌধুরী, মজিবুল হকও পাশে বসা। ইফতারের আয়োজন চলছে তখন।
তিন বছর আগে যখন এসেছিলেন আশ্রমে, তখন মাথার দু-একটি চুল কাঁচা ছিল তার। এখন সব চুলই পাকা। স্বামীর মৃত্যুর পরই জীবনের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এই বৃদ্ধার।
আদি নিবাস গোপালগঞ্জ। স্বামী জীবন বীমা কর্পোরেশনের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরির শুরু থেকেই ঢাকায় থাকতেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে স্বামীর সংসারে আনন্দময়ী ছিলেন সে নিজেই। চার বছর আগে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর পরই স্বর্গ সংসারে নরক নেমে আসে। ছেলেরা বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে দেয় বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পরই। ঠাঁই নেন বড় মেয়ের বাড়ি।
বড় ছেলে একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা। ছোট ছেলে এখন কোথায় আছে, তার ঠিকানা জানেন না মা। বড় মেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা। ঢাকায় দুটি বাড়ি তার। স্বামী পরিত্যক্ত বড় মেয়ের ঘরে এক মেয়ে। ছোট মেয়ের স্বামী ব্যবসা করেন। সবাই ঢাকায় থাকেন চাকরি এবং ব্যবসার সুবাদেই।
বৃদ্ধা বলেন, ওরা সবাই সুখী। সন্তানদের নিয়ে বেশ আছে। সবাই প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠিত হবেই না বা কেন? বাবার স্বপ্নই তো ছিল ওদেরকে নিয়েই। আমিও তো জীবনের সব দিয়েই ওদের আগলে রাখলাম। সব আয় ওদের জন্য ব্যয় করেই আমাদের আনন্দ ছিল। ছেলেরা চাকরি পেল। মেয়েদের বিয়ে দিলাম। বিয়ে করল ছেলেরাও। এরই মধ্যে ওদের বাবা মারা যায়। বাবার মরণের পর ছেলেরা বাড়ি থেকে বের করে দিল। কিছুদিন বড় মেয়ের বাড়িতে থাকলাম। সেখানেও ঠাঁই হল না। বড় মেয়ে রেখে গেল এই বৃদ্ধাশ্রমে।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘সেই যে এলাম, আজও আর গেটের বাইরে যেতে পারি নাই। মরণের পর হয়ত শেষ ঠিকানা হবে নারিন্দায় খ্রিষ্টান কবরস্থানে। এই আশ্রমে যারা আসেন, তারা নাকি মরণের পরই মুক্তি পায়।’
এএসএস/জেএইচ/আরআইপি