রুপন্তির বাবা এমন কেন?
ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ফারুক ও রোখসানা। বিয়ের আগে রোখসানাকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন ফারুক। রোখসানাকে পাওয়ার জন্য ১০ বছর অপেক্ষা করেছেন তিনি। অবশেষে বিয়েও হয়েছে তাদের। তাদের একটা সুন্দর-ফুটফুটে মেয়েও আছে। তবে বিয়ের পাঁচ বছরে ফারুকের হয়েছে অনেক পরিবর্তন। এখন তিনি প্রতিদিনই রোখসানাকে মারধর করেন। চোখের সামনে মায়ের উপর নির্যাতন দেখতে দেখতে ফুটফুটে মেয়েটি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। বাবার এমন আচরণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না মেয়েটি। এখন যেন সে হাসতেও ভুলে গেছে।
সবে সাড়ে চার বছর বয়স শিশু রুপন্তির। নিষ্পাপ চেহারায় তার বিষণ্নতার ছাপ। এ বয়সে সে এখনও জানে না ভালো-মন্দের সঠিক পার্থক্য। কিন্তু সে জানে তার বাবার শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে তার মা কতটা কষ্ট পাচ্ছে। জন্মের পর থেকেই তার মায়ের উপর বাবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন দেখতে দেখতেই বড় হচ্ছে সে। মায়ের উপর বাবার নির্মমতা দেখতে দেখতে শিশুটি ক্লান্ত। সর্বদা মানসিকভাবে ভীত থাকে সে।
‘অামার মেয়েটা জন্মের পর থেকেই দেখে অাসছে অামার উপর তার বাবার অত্যাচার। সে এসব দেখতে দেখতে এখন খুবই ভয় পাচ্ছে। কারও সাথে তেমন কথা বলে না। অামাকে ছাড়া কোথাও থাকে না। সারাক্ষণ অামার দিকে তাকিয়ে ভয়ে থাকে। প্রায় সময় তার শরীরে জ্বর থাকে। তাকে জড়িয়ে ধরে যখন ঘুমাতে যায়, তখন দেখি তার চোখে পানি। সে নীরবে কাঁদছে। এটা দেখে অামি তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে কোনো কিছুই বলে না। শুধু অামাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, মা! অাজকেও বাবা তোমাকে মারবে? তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না..?
এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কারণে সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বর্ণনা দিচ্ছিলেন স্বামী ফারুক সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে অাসা রোখসানা অাক্তার। বিয়ের পর থেকে স্বামীর শারীরিক নির্যাতনে বিধ্বস্ত তিনি নিজেও। একাধিকবার চিকিৎসা নিয়েছেন। এমনকি বহুবার ঢামেকে ভর্তিও ছিলেন। কিন্তু থামেনি স্বামীর নির্যাতন। উল্টো ক্রমেই বেড়ে চলেছে সেই নির্মমতা।
এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, তাদের বিয়ে হয়েছিল প্রায় সাড়ে ছয় বছর অাগে। অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১৮ এপ্রিল। বিয়ের অাগে প্রায় ১০ বছর ধরে তার স্বামী তার পিছে পিছে ঘুরেছিল তাকে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু তিনি রাজি ছিলেন না। পরে তার (রোকসানা) পরিবারের মাধ্যমে তাকে ফারুকের সঙ্গে বিয়েতে রাজি করায়। রোখসানার দাবি, বিয়ের অাগে তার স্বামী তাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। কিন্তু তিনি ফারুকের ভালোবাসায় সাড়া দেননি। এক পর্যায়ে রোখসানার পরিবারের মা বাবা ও অাত্মীয় স্বজনকে দিয়ে এ বিয়ে করতে রাজি করান ফারুক। এরপর শুরু হয় সংসার জীবন। কিন্তু বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই উন্মোচিত হয় স্বামী ফারুকের ভালোবাসার অাসল চেহারা।
তিনি বলেন, ‘বিয়ের ঠিক পনের দিন পরেই সে (স্বামী ফারুক) অামার গায়ে হাত তোলে। তার বোনের সঙ্গে একটা সামান্য কথা নিয়ে সে অামাকে কয়েকটা থাপ্পর মারে। কারণ তার পরিবারের কেউ অামাকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের দাবি, তাদের ছেলেকে অারও ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারত। কিন্তু অামার কারণে সেটি পারেনি এবং অামার বিয়েতে অামার বাবা-মা কোনো যৌতুক দিতে পারেনি। অথচ অামি নিজেই এ বিয়েতে রাজি ছিলাম না। এ কারণে তারা যা বলবে তাই শুনতে হবে। সেদিন তার বোন অামাকে এসব কথা তুলে খোঁটা দিচ্ছিল। তাদের কথার উত্তর দেয়ায় অামার উপর শারীরিক নির্যাতন করে সে। তারপর থেকেই শুরু হয় অামার উপর স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ ও ভাসুরদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
তিনি অারও বলেন, ‘তার এই নির্যাতনে ভেবেছিলাম শেষ হয়ে যাবে অাজ না হয় কাল। কিন্তু শেষ হয়নি। বিয়ের দেড় বছর পর যখন অামার মেয়ে রুপন্তির বয়স ছয় মাস, তখন তার নির্যাতনের কারণে অামাকে ঢাকা মেডিকেলে কয়েকদিন চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। অামাকে মারতে মারতে মুখের চামড়া ও বুকে দাগ লাগিয়ে ফেলেছে। বিয়ের পর প্রায় সাড়ে ছয় বছরে এমন কোনো দিন নাই যেদিন ঝগড়া হয়নি। অার ঝগড়া থেকে দুদিন পর পর অামার উপর চলত তার অমানবিক নির্যাতন-যা মুখে বলে শেষ করা যাবে না। প্রথমে যখন রুপন্তি পেটে অাসে, তারপর থেকে সন্তানের কথা ভেবে তার নির্যাতন সহ্য করেছি। ভেবেছি নিজে নিজে ভালো হবে। হয়নি। এরপর থানায় বহুবার তার বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সেই অাগের মতোই অাচরণ করে।
ঢামেকের জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে নিজের মেয়ে রুপন্তিকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বলার সময় মনে হচ্ছিল স্বামীর নির্যাতনে তিনি বড়ই অসহায়! মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, তার বাবা যখন বাসার দরজায় কড়া নাড়ে, তখনি রুপন্তি দৌড়ে এসে অামাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমাকে অাবারও মারবে? এ কথাটায় অামাকে সবচেয়ে বেশি অাঘাত করে! অবুঝ শিশুটিও অামার কষ্টটা বোঝে, অথচ স্বামী তা বোঝে না।
তিনি জানান, এ কারণে রুপন্তির চোখে-মুখে সব সময় এক ধরনের ভয় থাকে। সে খেলাধুলা করতে চায় না। সব সময়ে আমার অাশেপাশে থাকতে চায়। কারও সাথে মিশতে চায়না ও। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর দেয় না। সব সময় চুপচাপ থাকে।
রুপন্তির মানসিক সুস্থতা নিয়ে শঙ্কিত রোখসানা। এজন্য তিনি বিনামূল্যে অাইনি সহায়তা চান। বর্তমানে স্বামীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে তিনি বাড্ডার বেরাইদ ইউনিয়নে বাবার বাড়িতে থাকেন। এর অাগে উত্তরায় স্বামীর সঙ্গে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।
এসএইচ/এসআর/জেআইএম