পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশই দূষিত!
বাজারে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রিত পাস্তুরিত দুধের শতকরা ৭৫ ভাগই ব্যাকটেরিয়া দূষিত! আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষকরা শিশুদের পুষ্টির প্রাথমিক উৎস বাণিজ্যিকভাবে পাস্তুরিত দুধ সম্পর্কে নতুন গবেষণায় এ ফলাফল দেখতে পেয়েছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, খামার থেকে শুরু করে বিক্রয়ের দোকান পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দুধ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এটি শুধুমাত্র বিপজ্জনক হতে পারে যদি এ দুধ ‘কাঁচা’ (ফুটানো ছাড়া) অবস্থায় পান করা হয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো দেশে প্রায়ই কাঁচা দুধ পানের প্রবণতা দেখা যায়।
জানা গেছে, দুগ্ধ শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে দুধের অণুজীব বিজ্ঞানগত মান যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের দুধ উৎপাদকারী, হিমাগার এবং স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকে কাঁচা দুধের ৪৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া ঢাকা এবং বগুড়ার বিভিন্ন দোকান থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত দুধের ৯৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেন যে- প্রাথমিক দুধ উদপাদনকারী পর্যায়ে ৭২ শতাংশ ও ৫৭ শতাংশ নমুনা যথাক্রমে কলিফর্ম (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) এবং ফিক্যাল কোলিফর্ম (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত এবং নমুনাসমূহের ১১ শতাংশ উচ্চসংখ্যক ই. কোলাই (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) দ্বারা দূষিত। ফিক্যাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং দুধে এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির ফলে বুঝা যায় যে দুধ জীবাণু বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা দূষিত, যা উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মলে থাকতে পারে বা দুধ দোয়ানোর সময় দুধে মিশতে পারে।
উৎপাদনকারীদের থেকে দুধ সংগ্রহের স্থানে দেখা যায়, নমুনাসমূহ উচ্চসংখ্যক কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া (≥১০০ সিএফইউ/এমএল) দ্বারা দূষিত এবং মল দ্বারা দূষিত হওয়ার হার ছিল ৯১ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ নমুনায় উচ্চসংখ্যক ই. কোলাই ছিল।
হিমাগারসমূহে সংগৃহীত নমুনাসমূহে দুধ সংগ্রহের স্থানের নমুনাসমূহের চেয়েও দূষণের হার বেশি দেখতে পাওয়া যায়। পাঁচ জেলার ১৫টি হিমাগারে সংগৃহীত নমুনাসমূহে উচ্চসংখ্যক কলিফর্ম ও মলবাহিত কলিফর্ম পাওয়া যায়।
সবগুলো হিমাগার থেকে সংগৃহীত নমুনায় ই. কোলাই পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় ৬৭ শতাংশ নমুনা ই. কোলাই দ্বারা উচ্চমাত্রায় দূষিত। এছাড়াও বি. সেরেয়াস এবং স্ট্যাফাইলোকক্কির মতো আরও কিছু ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়, তবে এগুলোর মাত্রা ছিল স্বাভাবিক।
দেখা গেছে দুধ উৎপাদনকারীর থেকে শুরু করে, হিমাগার এবং সবশেষে ভোক্তা অর্থাৎ স্থানীয় রেস্তোরাঁ পর্যায় পর্যন্ত দুধে ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো-বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, পরীক্ষিত পাস্তুরিত দুধের নমুনার প্রায় ৭৭ শতাংশ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা (অ্যারোবিক প্লেট কাউন্ট) উচ্চমাত্রা বিশিষ্ট, যা বিএসটিআই-এর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) মানদণ্ডকে (≤২.০ঢ১০৪ সিএফইউ/এমএল) ছাড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে, ৩৭ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ নমুনা যথাক্রমে কলিফর্ম এবং মলবাহিত কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত ছিল। দুধকে পানের জন্য নিরাপদ করে তোলার জন্য একে পাস্তুরিত করা হয়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় মানদণ্ডে পাস্তুরিত দুধে এ ধরনের মলবাহিত কোলিফর্মের উপস্থিতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
একজন ভোক্তার জন্য এ ধরনের গবেষণা ফলাফল কেমন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইসিডিডিআর, বির সহযোগী বিজ্ঞানী ও ফুড মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরির প্রধান এবং এ গবেষণার প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ড. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, বাজারের পাস্তুরিত কাঁচা দুধে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে এবং এসব দুধ খুব ভালোভাবে না ফুটিয়ে খাওয়া উচিত নয়। তবে, ইউএইচটি দুধ থেকে সংগৃহীত নমুনায় জীবাণুর সংক্রমণ দেখা যায়নি, কাজেই সেগুলো পানের জন্য নিরাপদ। যা হোক, এ গবেষণায় আমরা দুধে রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা দূষণ এবং ভেজাল মিশ্রণ-সংক্রান্ত পরীক্ষা করিনি।
দুধের প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যায়সমূহ সম্পর্কে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি দেখে এটি স্পষ্ট বুঝা যায় যে, দুধের পুষ্টিগত গুণাগুণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
গবেষণাসমূহ থেকে দেখা গেছে, দুধের প্রাথমিক উৎপদানকারী পর্যায়ে এর দূষণের সঙ্গে গরুর প্রজনন প্রক্রিয়া, গুরুর দ্বারা উৎপাদিত দুধের পরিমাণ, দুধ দোয়ানোর সময় এবং যিনি দুধ দোয়ান তার হাত ধোয়ার অভ্যাসের মতো বিভিন্ন বিষয় জড়িত। সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের দুগ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বাস্থ্যকরভাবে দুধ দোয়ানো, সংগ্রহ ও সরবরাহ, সংরক্ষণ এবং পাস্তুরিত করার বিষয়ে যত্নবান হতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও, পানের জন্য দুধকে নিরাপদ রাখতে দুধ উৎপাদনের স্থান থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে পাস্তুরিত দুধকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।
কেয়ার বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় ‘স্ট্রেনদেনিং দ্য ডেইরি ভ্যালু চেইন (এসডিভিসি)’ প্রকল্পের আওতায় বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর এবং সিরাজগঞ্জের মোট ১৮ উপজেলায় এ গবেষণা পরিচালিত হয়।
গবেষণার ফলাফল ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড মাইক্রোবায়োলজি-তে প্রকাশিত হয়েছে।
এমইউ/এএইচ/জেআইএম