বেতবুনিয়া থেকে ফ্লোরিডা
>> বঙ্গবন্ধুর গড়ে দেয়া ভিতে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইটের যাত্রা
ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি শেষ। স্যাটেলাইট, লঞ্চার ও লঞ্চপ্যাড সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এখন চলছে সময়ের গণনা।
তথ্যপ্রযুক্তিতে দেশের আজকের এ অবস্থান একদিনে আসেনি। এ ইতিহাস বাংলাদেশের বয়সের প্রায় সমান। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে উদ্বোধন হওয়া বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র সর্বপ্রথম সারাবিশ্বের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যোগাযোগের সুদূরপ্রসারী ভিত রচনা করেছিল। এর সূত্র ধরে দেশ আজ মহাকাশ পাড়ি দেবার দ্বারপ্রান্তে।
আরও পড়ুন >> ‘ফাইনাল চেক অাউট সম্পন্ন’
জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত সেই বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের পাশেই পাঁচ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ‘বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন-২’। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (১১ মে) দিবাগত রাত ১টা ৩৭ মিনিটে শুরু হবে এ স্বপ্নযাত্রা।
মহাকাশে পাড়ি দেয়ার পর এটির নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে। ওই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্লট) স্থাপন করা হবে। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগবে। সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে।
গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন এ জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
গত বুধবার সরেজমিন বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন পরিদর্শন করে এর কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় জাগো নিউজ’র। তারা জানান, স্টেশনটি ব্যাকআপ স্টেশনে হিসেবে কাজ করবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে পাড়ি দেয়ার এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগবে। এরপর এর নিয়ন্ত্রণ গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে।
বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র পরিদর্শনে দেখা যায়, এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের টেলিযোগাযোগের প্রথম এন্টেনাটি। কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে এটি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্রুততার সাথে তথ্য আদান-প্রদানের কাজ পরিচালিত হচ্ছে। একসময় সমগ্র বাংলাদেশে বৈদেশিক কল গ্রহণ ও পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল রাঙ্গামাটির এ কেন্দ্র। সরকার তথা রাষ্ট্র, বিদেশি কূটনীতিক কিংবা ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সব যোগাযোগ হতো এর মাধ্যমে। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গঠনে এ কেন্দ্রের অবদান ছিল অপরিসীম।
কয়েকশ' গজ ব্যবধানে দুটি ফটক পার করে যেতে হয় মূল কেন্দ্রে। পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে মূল ভবনের জৌলুস যেন অমলিন রয়েছে। পাশেই বঙ্গবন্ধুর উদ্বোধনী মঞ্চ আর বিশালাকার এন্টেনা (ডিশ)। ডান পাশের দেয়ালজুড়ে আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামাঙ্কিত ফলক। তিনি এর উদ্বোধন করেন ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন। এদিন একটি ডাকটিকিটও অবমুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু।
একটু ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন জাতির জনক যে স্থানে দাঁড়িয়ে এ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন সেই স্থানটি। যেটিকে সিবিএর উদ্যোগে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ফলক উন্মোচনী পাথরটি বসানো হয়েছে মূল কার্যালয়ের সম্মুখভাগে। কেন্দ্রের উদ্বোধন শেষে যে জায়গা থেকে জাতির জনক হেলিকপ্টারযোগে উড্ডয়ন করেছিলেন সেই জায়গাটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখন স্থানটি ঈদগাহ মাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
পাহাড় বেষ্টিত ১২৮ একর সমতল জমিতে স্থাপন করা দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গত শতাব্দীর আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যয়বহুল স্থাপনাটি মূলত কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে শক্তিশালী এন্টেনার মাধ্যমে ওভারসিস সিগন্যাল গ্রহণ করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে টেলিফোন ডাটা কমিউনিকেশন, ফ্যাক্স, টেলেক্স আদান-প্রদান করে আসছে।
১৯৭০ সালের ৩ জানুয়ারি যখন এটি স্থাপন করা হয়, তখন এর নামকরণ করা হয় উপগ্রহ যোগাযোগ কেন্দ্র, পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৯৭০ সালের ৩০ জানুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, হংকং, ওমান, পাকিস্তান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মুম্বাই অর্থাৎ মোট ১১টি দেশের সঙ্গে টেলিফোন ডাটা কমিউনিকেশন, ফ্যাক্ম, টেলেক্ম ইত্যাদি আদান-প্রদান করা হয়।
স্মৃতিতে অমলিন বঙ্গবন্ধু :
বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে যৌবনের শুরুতেই চাকরি নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ছেলে মো. আবদুল মান্নান। বর্তমানে অবসরে যাওয়া আবদুল মান্নান রাঙ্গামাটির কাউখালি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা আবদুল মান্নান জাগো নিউজকে জানান, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির সে দিনটি এখনও যেন চোখের সামনে ভাসছে তার।
তিনি গর্ব করে বলেন, ‘আশির দশকের বিশ্বকাপ ফুটবলে ম্যারাডোনার খেলা আর মুষ্টিযুদ্ধে সারা দুনিয়ার সেরা মোহাম্মদ আলীর খেলা হলে এ কেন্দ্রের মাধ্যমেই সমগ্র বাংলাদেশে তা দেখানো হতো। এমনকী বাইরের সব অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো এর মাধ্যমে।’
আবদুল মান্নানের কাছে বেতবুনিয়া উপগ্রহ কেন্দ্রের উদ্বোধনের দিনটি এখনও 'সেরা'। তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বলেন, ‘চারপাশে ছোট ছোট পাহাড়। ওইদিন জনমানবহীন পাহাড়ও লোকারণ্য হয়ে পড়ে। বাগানে বসেই বঙ্গবন্ধু চা-পান করলেন। অদূরে শুয়ে থাকা একটি কুকুরকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, 'তুইও আমার মতো ভুখা? হাতের বিস্কুট ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘নে খা'।
মান্নান বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৪ জুন। ওইদিন সকাল ১১টায় বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের প্রথম গেটে একটি হাতি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। বেজায় খুশি হলেন তিনি। বহর নিয়েই এলেন উদ্বোধনস্থলে। প্রচুর সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি উদ্বোধনী মঞ্চ ঘিরে। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে উদ্বোধন করে মোনাজাত করলেন বঙ্গবন্ধু। তারপর অফিসের ভেতরে সবটুকু ঘুরে দেখলেন। সবশেষে ফিরে গেলেন। কিন্তু সেই যাত্রাই যে শেষ যাত্রা কে জানতো?’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারের নৃশংসভাবে হত্যার পর ক্ষমতায় আসীন পরবর্তী স্বৈরাচারী সরকার এবং ১৯৯০ -এর পরবর্তীতে দু-দফায় দেশ পরিচালনায় এসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রটিকে কার্যত অচল করে দেয়।’
বঙ্গবন্ধুর গড়ে দেয়া সেই ভিতে আজ আবারও ইতিহাস গড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আজ আবারও উজ্জ্বল বেতবুনিয়ার পাহাড়। বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের পাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের পাশে অবস্থিত ‘বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে’র ১২৮ একরের জায়গার পাঁচ একরজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন-২’।
গাজীপুরে অবস্থিত ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন ও বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। একই নকশায় গড়ে তোলা হয়েছে দুটি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন।
ডিম্বাকৃতির একটি ভবন ব্যবহার হবে মূল ভবন হিসেবে। এর ভেতরে আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে স্যাটেলাইট অপারেশন, কন্ট্রোল সেন্টার ও নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার বিভাগ।
মূল ভবনের বাইরে বসানো হয়েছে বিশাল দুটি এন্টেনা। কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের জন্য রয়েছে ডরমেটরি ভবন। যেখানে ৩০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে পাশেই তৈরি করা হয়েছে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন (৩৩ কেভি)। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পেতে বিটিসিএলের তত্ত্বাবধানে নিশ্চিত করা হচ্ছে নিখুঁত ফাইবার অপটিক সংযোগ।
আরও পড়ুন >> একনজরে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট
বর্তমানে ছয়জন প্রকৌশলী বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশনের দেখভাল করছেন। এছাড়া অপারেশন ইউনিটের সবাই ঢাকার গাজীপুরে অবস্থান করছেন। স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের হাতে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা কে, কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন। মূল অপারেশন প্যানেলের দুই কেন্ট্রোল স্টেশনে কাজ করবেন ৩০ জন। তবে উৎক্ষেপণের পর তিন মাস থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস স্যাটেলাইটের দেখভাল করবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পৃথিবী থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ অবস্থান করবে। সেখান থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করার সরল রৈখিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বেতবুনিয়ার এ স্থানটিকেই উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা জানান, উৎক্ষেপণ করার পর স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগবে। এরপর থেকে স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণের মূল কাজ হবে জয়দেবপুর স্টেশনে। তবে কখনও যদি গাজীপুর স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তখন বেতবুনিয়ার গ্রাউন্ড স্টেশন-২ কাজ শুরু করবে। অনেক ক্ষেত্রে দুই গ্রাউন্ড স্টেশনেই সমানতালে কাজ হবে।
বেতবুনিয়া কেন্দ্রের পরিচালক দিপ্তিময় চাকমা জানান, বেতবুনিয়া কেন্দ্রে শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইটের সঙ্গে সংযুক্ত। দেশে সাবমেরিন ক্যাবল যুক্ত হওয়ায় এর ব্যবহার আপাতত সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর এ কেন্দ্রের কার্যকারিতা আরও বেড়ে যাবে।
আবু আজাদ/এমএআর/আরআইপি