স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুত ‘বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন’
বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর মহাকাশে ডানা মেলতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টায় শুরু হবে এ স্বপ্নযাত্রা।
মহাকাশে পাড়ি দেয়ার পর এটির নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যাবে। ওই তিন স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটটিকে নিয়ন্ত্রণ করে এর নিজস্ব কক্ষপথে (১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্লট) স্থাপন করা হবে। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগবে। সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে। গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশনের নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
গত বুধবার সরেজমিন বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন পরিদর্শন করে এর কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় জাগো নিউজ’র। রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক এ কে এম মাহমুদুর রহমান সার্বিক প্রস্তুতির কথা জানিয়ে বলেন, ‘বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন-২ তার কাজের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। উৎক্ষেপণের নতুন তারিখ ঠিক হওয়ার পরপরই কর্মকর্তা ও অপারেশন প্রকৌশলীরা সব ধরনে প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শেষ করেছেন। শুধু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনটাই বাকি। ৪ মে আমি সরেজমিন প্রজেক্ট এলাকা পরিদর্শন করে এসেছি।’
আরও পড়ুন >> স্যাটেলাইটে লেখা থাকছে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’
প্রকল্প পরিচালকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, ফ্লোরিডাতে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ছয়-সাতদিন পর থেকে এ গ্রাউন্ড স্টেশন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ন্ত্রণে পুরোদমে কাজ শুরু করবে।’
বেতবুনিয়ার গ্রাউন্ড স্টেশনে কর্মরত প্রকৌশলীরা জানান, স্টেশনটি ব্যাকআপ স্টেশনে হিসেবে তৈরি করা হলেও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে পাড়ি দেয়ার পর বাংলাদেশের পক্ষে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ নেবে রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন-২। স্যাটেলাইটটি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগবে। এটি সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে।
আরও পড়ুন >> স্যাটেলাইটে কী সুবিধা পাবে বাংলাদেশ
মূলত বেতবুনিয়ায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন-২ এর ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগাতেই এটি ব্যবহার করা হবে। স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কাজ হবে জয়দেবপুরের স্টেশনে। তবে কখনও যদি গাজীপুর স্টেশন স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তখন বেতবুনিয়ার গ্রাউন্ড স্টেশন-২ কাজ শুরু করবে। অনেক ক্ষেত্রে দুই গ্রাউন্ড স্টেশনেই সমানতালে কাজ চলবে।
স্যাটেলাইট নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, উপগ্রহটি ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য সাতদিন সময় নেবে। কয়েক দিন ধরে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর উপগ্রহটিকে পর্যায়ক্রমে বেতবুনিয়া ও গাজীপুর গ্রাউন্ড স্টেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।
আরও পড়ুন >> কতদিনে পৌঁছাবে বঙ্গবন্ধু-১
বেতবুনিয়ায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনে নিয়োজিত একাধিক প্রকৌশলী জাগো নিউজকে জানান, উৎক্ষেপণ স্থান থেকে ৩৬ হাজার ৭০০ কিলোমিটার যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-২ খুলে যাবে। এ জন্য সাত থেকে ১০ দিন সময় লাগবে। স্যাটেলাইট উন্মুক্ত হওয়ার পরপর এর নিয়ন্ত্রণ নেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন। এরপর শুরু হবে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ২০ দিন এটি চলবে। সম্পূর্ণ চালু হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় অবস্থিত দুটি গ্রাউন্ড স্টেশনে হস্তান্তর করা হবে।
এ প্রসঙ্গে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, মহাকাশে থাকা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ন্ত্রণ করা হবে জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ার দুই গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে। পৃথিবীর অরবিটে থাকা স্যাটেলাইট তার জায়গা থেকে মাঝে মাঝে সরে যেতে পারে। সেখানে আমাদের একটি ৭৫ কিলোমিটার জায়গা আছে। এর মধ্যে স্যাটেলাইটটি রাখতে হবে। কাজটি এখান থেকে করা হবে। এছাড়া যাবতীয় মেইনটেন্যান্স কাজ এখান থেকে করা হবে।’
আরও পড়ুন >> যেভাবে মহাকাশে পৌঁছাবে বঙ্গবন্ধু-১
তিনি আরো বলেন, ‘স্যাটেলাইট পাঠানোর কাজটি বিদেশে হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ হবে জয়দেবপুর ও বেতবুনিয়া থেকে। এ লক্ষ্যে গত জুলাই মাসে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের যন্ত্রপাতিও আমদানি করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।’
সরেজমিন বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন পরিদর্শনে দেখা যায়, রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের পাশে অবস্থিত ‘বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে’র ১২৮ একর জায়গার পাঁচ একরজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ‘বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন-২’। গাজীপুরে অবস্থিত স্টেশনের সঙ্গে বেতবুনিয়া স্টেশনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। একই নকশায় গড়ে তোলা হয়েছে দুটি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন। ডিম্বাকৃতির একটি ভবন ব্যবহার হবে মূল ভবন হিসেবে। এর ভেতরে আলাদাভাবে সাজানো হয়েছে স্যাটেলাইট অপারেশন, কন্ট্রোল সেন্টার ও নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার বিভাগ।
আরও পড়ুন >> ‘এটা আমাদের জাতিগত অনেক বড় পাওয়া’
মূল ভবনের বাইরে বসানো হয়েছে বিশাল দুটি এন্টেনা। কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের জন্য রয়েছে ডরমেটরি ভবন। যেখানে ৩০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে পাশেই তৈরি করা হয়েছে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন (৩৩ কেভি)। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সুবিধা পেতে বিটিসিএলের তত্ত্বাবধানে নিশ্চিত করা হচ্ছে নিখুঁত ফাইবার অপটিক সংযোগ।
বর্তমানে ছয়জন প্রকৌশলী বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশনের দেখভাল করছেন। এছাড়া অপারেশন ইউনিটের সবাই ঢাকার গাজীপুরে অবস্থান করছেন। স্যাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের হাতে প্রশিক্ষিত বাংলাদেশি প্রকৌশলীরা কে, কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন। মূল অপারেশন প্যানেলের দুই কেন্ট্রোল স্টেশনে কাজ করবেন ৩০ জন। তবে উৎক্ষেপণের পর তিন মাস থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস স্যাটেলাইটের দেখভাল করবে।
আরও পড়ুন >> একনজরে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১
প্রজেক্ট সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে বেতবুনিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়। অবকাঠামোসহ কারিগরি কাজ শেষ হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। যদিও এর আগে নভেম্বর থেকে গ্রাউন্ড স্টেশনের পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হয়।
প্রকল্পের অবকাঠামো তৈরির কাজ করেছে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর ফরাসি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের নিয়োগকারী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’।
আরও জানা যায়, গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ার দুটি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশনের যন্ত্রপাতি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে বিটিআরসি। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে গ্রাউন্ড স্টেশনে সিগন্যাল আদান-প্রদানে ১০ টন ওজনের দুটি এন্টেনা স্থাপন করা হয়। এন্টেনা দুটির একটি ২৬ কি-কিউ-ব্যান্ড এবং অন্যটি ১৪ সি-ব্যান্ড, যা স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণে ট্রান্সপন্ডার হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর স্থাপন ও বিদ্যুৎ সরবরাহে দুটি বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে বিদুৎ সংযোগ স্থাপন করা হলেও খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙ্গামাটির মানিকছড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগটি পেতেও চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আবু আজাদ/এমএআর/আরআইপি