নেপালের নিয়ম রক্ষার প্রতিবেদনে বিধ্বস্তের কারণের ‘ক’ও নেই
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিএস-২১১ ফ্লাইট বিধ্বস্তের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশটির ‘এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিশন’। সম্প্রতি নেপালের মিনিস্ট্রি অব ট্যুরিজম অ্যান্ড কালচারের ওয়েবসাইটে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, রিপোর্টটি ছিল সম্পূর্ণ নিয়ম রক্ষার জন্য। এতে বিমান বিধ্বস্তের কারণের ‘ক’ও উঠে আসেনি।
প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করা দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী যেকোনো বিমান দুর্ঘটনার এক মাসের মাথায় একটা প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে হয়, এই নিয়ম রক্ষার্থে প্রতিবেদনটি দেয়া হয়েছে। এতে উল্লেখযোগ্য কিছুই লেখা হয়নি, এমনকি দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে ধারণাও দেয়া হয়নি। প্রতিবেদনের কয়েকটি অংশ বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী,বিমানটি বিধ্বস্তের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে আহতদের উদ্ধার করে। তদন্ত অনুযায়ী উদ্ধারকর্মীরা ঘটনার দুই মিনিটের মধ্যে এসে ৪টি বড় ফোম টেন্ডার, ১টি মাঝারি সাইজের ফোম টেন্ডার ও দুই টাংকি পানি ব্যবহার করে।’
তবে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে বেঁচে যাওয়া যাত্রী সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস যেসব উদ্ধারকর্মী ছিলেন, তাদের দেখে মোটেও অভিজ্ঞ মনে হয়নি। তাদের কেউ ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল না, দূর থেকে আগুন নেভাচ্ছিল। কোনোভাবেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না। ব্লাস্টের শব্দ শুনেই সবাই পেছনে দৌড়ে পালাচ্ছিল।’
দুর্ঘটনা কবলিত উড়োজাহাজে অলৌকিকভাবে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী কাঠমান্ডুস্থ ‘লাকি ট্রাভেলস’ এর মালিক সনম সাথিয়া। এই যাত্রী বলেন, ‘দুই মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছায়নি। তারা আসতে অনেক বিলম্ব করেছে। আগুন নিভাতেও অনেক সময় নিয়েছে। তাদের বিলম্ব না হলে আরও যাত্রীদের বাঁচানো সম্ভব হতো।’
উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রি জাগো নিউজের কাছে দাবি করেন, ‘উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের স্পট থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ২০০ মিটারের দূরত্বে ছিল। টাওয়ারে প্লেন ক্র্যাশের সংবাদ শোনার দুই মিনিটের মাথায় পাঁচটি গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছে। প্লেনের আগুন তীব্র ছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্লেনের ৪০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। ফায়ার ফাইটার, সেনাবাহিনী, পুলিশ- সবাই ভালোভাবে কাজ করেছেন। পত্রিকায় পড়লাম, একজন বাংলাদেশি যাত্রীও উদ্ধারকর্মীদের প্রশংসা করেছেন।’
প্রতিবেদনে ‘কমিউনিকেশনস’ অংশে বলা হয়েছে, ‘দুপুর ২টা ১৭ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড পর্যন্ত ককপিট ও টাওয়ার কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ স্বাভাবিক ছিল কিন্তু এরপর থেকে ২টা ১৮ মিনিট ৪৫ সেকন্ড পর্যন্ত টাওয়ার আর ককপিটের মধ্যে কোনো কার্যকর যোগাযোগ ছিল না।’
এই অংশটুকুর সমালোচনা করে বাংলাদেশের একাধিক পাইলট জাগো নিউজকে জানান, সাধারণত টাওয়ার থেকে বিমান অবতরণের চূড়ান্ত অনুমতি পাওয়ার পর টাওয়ারের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ হয় না। তবে যদি পাইলট কিংবা টাওয়ার জরুরি মনে করে তবে তারা যোগাযোগ করতে পারে।
ইউএস-বাংলার বিমানটির এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) টাওয়ার থেকে কমপক্ষে তিনজন কথা বলেছিল। জানা গেছে, তারা সবাই অন-জব ট্রেনিংয়ে (ওজেটি) দায়িত্ব পালন করছেন। প্রাথমিক প্রতিবেদনে তাদের বক্তব্য কিংবা ভূমিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয়া হয়নি।
তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের ব্ল্যাকবক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ সব সরঞ্জাম বিচার বিশ্লেষণের জন্য কানাডার ট্রান্সপোর্ট সেফটি বোর্ডের কাছে পাঠানো হয়েছে’ -এই তথ্য গত ১৫ দিন আগ থেকেই সবার জানা। এছাড়াও রিপোর্টটিতে প্লেনের পাইলট ক্যাপ্টেইন আবিদ সুলতানসহ অন্যান্যদের মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয়নি। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দাবি করেছে, আবিদের মরদেহ সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। তার আবিদের মৃত্যুর কারণ জানে না তারা।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক হুসাইন বলেন, ‘রিপোর্টে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো অনেক আগেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে চলে এসেছে। তদন্ত কমিশন চাইলে প্রাথমিক রিপোর্টে কিছু বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে পারতো। রিপোর্টটি পড়ে মনে হয়েছে- নেপাল কর্তৃপক্ষ এখনই গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। এখন সারাবিশ্ব বিধ্বস্তের কারণ জানতে উন্মুখ হয়ে আছে। এক বছর পর অনেকেরই এমন আগ্রহ থাকবে না। সে কারণেই হয়তো এমন রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।’
তবে প্রাথমিক রিপোর্টটি ওয়েবসাইটে সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য পাবলিক করে দেয়ার বিষয়টি ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের উপ-পরিচালক উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রাথমিক প্রতিবেদনে বিমানটি কীভাবে আছড়ে পড়েছে সেই ঘটনা বলা হয়েছে। এখানে যা বলা হয়েছে মুল প্রতিবেদনে তার উল্টোও হতে পারে। সিভিল এভিয়েশন চাইলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি জানাতে পারে, সেই সুযোগ আছে।’
প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস-২১১ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। চার ক্রু ও ৬৭ জন যাত্রী নিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৫১ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। বাকিদের উদ্ধার করে নেপালের কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ (কেএমসি) হাসপাতাল, নরভিক হাসপাতাল, গ্রান্ডে হাসপাতাল, ওম হাসপাতাল ও মেডিসিটিতে ভর্তি করা হয়।
বিমানটিতে মোট ৬৭ যাত্রীর মধ্যে বাংলাদেশি ৩২ জন, নেপালি ৩৩ জন, একজন মালদ্বীপের ও একজন চীনের নাগরিক ছিলেন। তাদের মধ্যে পুরুষ যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৩৭, মহিলা ২৮ ও দু’জন শিশু ছিল। আর চার ক্রু’র সবাই বাংলাদেশি।
আরএম/এআর/এমবিআর/জেআইএম