কমিশনে হয় কৃত্রিম অঙ্গের কাজ
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের কমিশন দেয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বানানোর কাজ পায় শ্যামলী ও শেরেবাংলা নগরের ব্যবসায়ীরা। ক্ষেত্র বিশেষে চিকিৎসককেও কমিশন দিতে হয়। নিটোর আশপাশে অবস্থিত কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রস্তুতকারক এবং পঙ্গুদের বিভিন্ন সার্জিক্যাল সামগ্রী বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
পরিচয় গোপন করে এই এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরির সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের অলিখিত চুক্তি আছে। সেই চুক্তি মোতাবেক হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় ও নার্সরা প্রতিষ্ঠানকে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরির কাজ পাইয়ে দেন।
এর বিনিময়ে ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডবয় বা নার্সকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিয়ে থাকেন। ধরা যাক, একজন রোগীর একটি কৃত্রিম পা বানাতে ব্যবসায়ী ২০ হাজার টাকা নিলেন। তাহলে এই টাকা থেকে ওয়ার্ডবয় বা নার্স দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন পান। আর ওয়ার্ডবয় বা নার্সদের এই কমিশনের একটি অংশ কিছু চিকিৎসকও পান।
হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের কমিশন দেয়ার মাধ্যমে কাজ পাওয়ার কথা এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন অঞ্চলটিতে প্রায় ২০ বছর ধরে কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরির ব্যবসায় জড়িত মো. সেলিম।
সেলিম সার্জিক্যাল আর্টিফিসিয়াল লিম সেন্টারের মালিক এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগে আমাদের প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের ভেতরে ছিল। এখন হাসপাতালের ভেতরে শুধু সরকারি ওয়ার্কশপ আছে। তবে ওই ওয়ার্কশপে রোগীদের কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করা হয় না। বছরে দুই-একবার হাসপাতাল থেকে রোগীদের কৃত্রিম অঙ্গ দেয়া হয়।’
হাসপাতাল থেকে দূরে থাকার পরও রোগীরা কীভাবে আপনাদের প্রতিষ্ঠান চিনতে পারে? এমন প্রশ্ন করা হলে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এটা কোনো সমস্যাই না। হাসপাতালে আমাদের লোক আছে। প্রতিটি কাজের জন্য আমরা ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের কমিশন দেই। আমরা যাদের কমিশন দেই তারাই আমাদের কাজ পাইয়ে দেন। ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই ওয়ার্ডবয় ও নার্সরা আমাদের কজ পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।’
তিনি বলেন, ‘মাঝে মধ্যে আমরা ডাক্তারদের সঙ্গে সরাসরিও যোগাযোগ করি। কারণ কিছু বিষয় আছে ডাক্তাররা বোঝেন না। তারা প্রেসক্রিপশনে যা লেখেন, বাস্তবে তার মিল থাকে না। সে ক্ষেত্রে আমরা ডাক্তারকে ফোন দিলে তারা বলেন- যেভাবে হবে সেইভাবে তৈরি করে দাও। শনিবার (২১ এপ্রিল) যশোরের এমন একটি রোগী এসেছিল। আমরা মাপযোগ নিয়ে দেখলাম ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে যেভাবে লিখেছেন তার সঙ্গে মিলছে না। এরপর ফোন দিলে ডাক্তার বলেন, আপনারা অভিজ্ঞ। তাই যেভাবে হবে সেভাবেই তৈরি করে দেন।’
ওয়ার্ডবয় বা নার্সদের কেমন কমিশন দিতে হয়? জানতে চাইলে তিনি বলন, ‘২০ হাজার টাকার একটি কাজ পেলে হাসপাতালের লোকদের দিতে হয় দুই হাজার টাকা। অল্প টাকার কাজ পেলে ৫০০-৬০০ টাকা দিতে হয়। এভাবে কাজের ওপর ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের কমিশন নির্ভর করে। পঙ্গুদের কৃত্রিম হাত ও পাসহ সবধরনের সামগ্রী আমাদের কাছে পাওয়া যায়। শুধু আমরা না, এখানে যারাই কৃত্রিম অঙ্গ তৈরির কাজ করেন প্রত্যেককেই কমিশন দিতে হয়।’
হাসপাতালের ভেতরে থাকা ওয়ার্কশপের ম্যানেজার মোজাহার মোল্লা বলেন, ‘আমরা যাদের কৃত্রিম পা দেই তাদের কোনো টাকা দেয়া লাগে না। তবে সব সময় এটা দেয়া সম্ভব হয় না। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ৫০০-৬০০ কৃত্রিম পা দেয়া হয়। ভারতের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজ উদ্যোগে এসে এসব পা প্রতিস্থাপন করে দিয়ে যায়।’
এদিকে নিটোরকে কেন্দ্র করে শ্যামলী ও শেরেবাংলা নগরে পঙ্গুদের সামগ্রী তৈরি বড় একটি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়েছে। এক সময় অঞ্চলটিতে হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও, এখন প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ফলে রোগী বাড়লেও আয় কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সাহবুদ্দিন সার্জিক্যালের মালিক সাহবুদ্দিন বলেন, ‘আমরা অর্থোপেডিকের সবধরনের সার্জিক্যাল পণ্য বিক্রি করি। আগের থেকে এখন রোগী অনেক বেশি আসে, তবে বিক্রি কম। কারণ এখন অনেক প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। কিন্তু ৫-৭ বছর আগে এখানে ৪-৫টি প্রতিষ্ঠান ছিল। প্রতিযোগী বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন ব্যবসা খুব একটা ভালো হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, হুইল চেয়ার, কমোড চেয়ার, বেল্ট, ওয়াকার বেশি বিক্রি হয়। আমাদের কাছে এখন যেসব রোগী আসে এর বেশিরভাগই হাত-পায়ের রোগী।
একই ধরনের তথ্য দিলেন জহির সার্জিক্যালের মো. জহিরুল ইসলাম এবং কামাল সার্জিকালের পারভেজ।
এমএএস/বিএ/আরআইপি