মৃত্যু-রগকাটার স্ট্যাটাস : ১০ ফেসবুক আইডি'র দিকে নজর
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের প্রথম দিনে ‘পুলিশের গুলিতে আহত আবু বকর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী মারা গেছেন’ এমন স্ট্যাটাস দিয়ে মৃত্যুর গুজব ছড়ানোয় ২০০টি ফেসবুক আইডি’র তালিকা করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের অ্যাকাউন্টসহ ৩০টি আইডি ও পেজকে বিভ্রান্তির ছড়ানোয় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থান নিশ্চিত হবার পর তাদের নজরদারিতে আনা হয়েছে।
ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু প্রকৃত অপরাধীদের ধরতেই পুলিশ আরও সময় নিচ্ছে। সম্পূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণের ভিত্তিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় মৃত্যু ও রগ কাটার গুজব রটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হবে। তাদের ধরতে ইতোমধ্যে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) এর কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত নেয়া হয়েছে। ওই সব ব্যবহারকারীর বিস্তারিত তথ্য চেয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কোটা সংস্কারে দাবিতে শুরুর দিকে আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আন্দোলনের ব্যাপারে পুলিশ কিংবা সরকারের মৌন সমর্থন ছিল। তবে শুরু থেকে একটা আশঙ্কা ছিল আন্দোলন কোনো এজেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রণ কিংবা বিভ্রান্তির দিকে যাচ্ছে কিনা। যারা ভিন্ন মতাবলম্বী কিংবা সরকারকে যারা বেকায়দায় ফেলাতে চায় তারা শুরু থেকেই সেই চেষ্টায় ছিল।
তারা বলছেন, ওই আশঙ্কা থেকেই পুলিশ আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানায়, ‘আপনাদের দাবি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হবে। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেন, নেবেন।’ কিন্তু আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে পুলিশের ওপর ঢিল ছোড়া হয়। এরপর পুলিশ টিয়ারশেল, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ব্যবহার ও লাঠিচার্জ করে আন্দোলনকারীদের শাহবাগ থেকে সরিয়ে দেয়। এসবই করতে হয়েছিল আন্দোলনকারীদের শাহবাগ থেকে সরিয়ে দিতে। কোনো প্রাণনাশের জন্য নয়। কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়ানো হয় পুলিশের গুলিতে আবু বকর নামে একজন নিহত হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ওই দিন রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেয়া হয় যে, ‘আবু বকর নামে এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে।’ এরপর আন্দোলন ভিন্ন রূপ নেয়। আরও বেশ কিছু আইডি থেকে একই ধরণের বিভ্রান্তি ছড়নো হয়। যদিও এর আগে ওই সব ফেসবুক আইডি থেকে শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য ডাক দেয়া হয়েছিল। ওই সব ডাক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে পুলিশ সবসময় সম্মান জানায়। কিন্তু প্রোপাগান্ডাকে প্রশ্রয় দেয় না।
পুলিশ কর্মকর্তারা আরও বলেন, ওই প্রোপাগান্ডার পর আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে ঢাবি উপাচার্যের বাসায় হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়। ওই রাতটি ছিল আতঙ্কের রাত। ভিসির বাস ভবনে এক রকম তাণ্ডব চালানো হয়। যদিও পরে জানা যায়, ওই রাতে আবু বকর মারা যায়নি। এরপর আন্দোলনের মধ্যেই পরদিন রাতে এক ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক আরেক ছাত্রীর রগ কাটার গুজব ছড়ানো হয়। পরে জানা যায়, রগ কাটার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা আন্দোলনের সময় ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য প্রচার, মৃত্যু ও রগ কাটার গুজব ছড়ানো এবং উসকানিমূলক তথ্য প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে গত ১১ এপ্রিল তথ্যপ্রযুক্তি আইনে (আইসিটি) ডিএমপির সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপ-পরিদর্শক (এসআই) এস এম শাহজালাল বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে কারও নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। তবে মামলায় কোটা আন্দোলন নিয়ে গুজব ছড়ানো বিভিন্ন ফেসবুক আইডির নাম ও পোস্ট সংযুক্ত করা হয়েছে।
ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাবির ছাত্র আবু বক্কর সিদ্দিকের অজ্ঞান অবস্থার ছবি তুলে তার মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়। মৃত্যুর গুজব সবচেয়ে বেশি ছড়ানো হয় ইমরান এইচ সরকারের ভেরিফায়েড পেজ থেকে। পেজটিতে সাড়ে ১৪ লাখের বেশি লাইকার রয়েছেন।
এরপর ইমরানের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে আরও ২০-২৫টি অ্যাকাউন্ট ও পেজ শনাক্ত করা হয়, যেগুলো থেকে ফেসবুকে মৃত্যুর গুজব ছড়ানো ও আন্দোলনে উসকানি দেয়া হয়েছিল। পরে ওই শিক্ষার্থীই জানান, তিনি বেঁচে আছেন।
বৃহস্পতিবার (১৯ এপ্রিল) যোগাযোগ করা হলে ডিএমপি’র সাইবার ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মৃত্যুর গুজব ও উসকানিমূলক পোস্ট দেয়ায় মোট ২০০টি আইডির ব্যাপারে খোঁজ খবর শেষে ৩০টি আইডি শনাক্ত করা হয়।
ওইসব আইড ‘র ব্যবহারকারীদের নাম, মোবাইল নাম্বার ও মেইল অ্যাড্রেসসহ বিস্তারিত তথ্য চেয়ে ফেসবুকের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। বিটিআরসি’র কাছ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে। এসব আইডি কার নামে কোন ফোন থেকে ব্যবহার কারা করছে তা জানতে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) এর তথ্য নেয়া হচ্ছে। আইডি’র মালিকানা নিশ্চিত হবার পর মূল হোতা বেড়িয়ে আসবে। আমাদের টার্গেট কোনো ব্যক্তি নয়, ওইসব গুজব রটানো ব্যক্তিকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম দিনেই পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যুর কথা জানিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন ইমরান এইচ সরকার। তাকে গ্রেফতারের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ ভুল করতে চায় না। কিছু ভিন্ন মতাবলম্বী যারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চান তারাই যে এই গুজব ছড়িয়েছেন তা স্পষ্ট। আমরা ১০ জনকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করেছি। তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে নজরদারিতে রেখেছি। যত বড় পাবলিক ফিগারই হোক না কেন অপরাধীদের ছাড় নয়। গ্রেফতারের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।’
জেইউ/এমবিআর/এমএস