লাইফ সাপোর্টে রাজীব : থমকে অাছে ছোট্ট একটা স্বপ্ন!
রাজীব হোসেন। ২১ বছরের টগবগে তরুণ। মায়াবী মুখের চাহনি সহজেই বলে দিচ্ছে কতটা ক্লান্তি চেপে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টায় ছুটে চলছে অবিরত। অাট বছর বয়সে মা অার চৌদ্দ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে প্রতিকূলতার সিঁড়ি বেয়ে শুরু হয়েছিল তার পথচলা। সেই ছুটে চলা পথে সহস্র প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে অন্ধকারে হেঁটেছে অালোর মশাল হাতে নিয়ে। দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও জীবন যুদ্ধে কখনো হারেনি সে। সবকিছুতে অল্পতেই খুঁজে পেতো স্বাচ্ছন্দ্যবোধ।
তাই তো তার জীবনে ছিল না বড় কোনো স্বপ্ন। শুধু স্বপ্ন দেখতো মা-বাবা হারা এতিম ছোট দুই অাপন ভাই অাবদুল্লাহ ও মেহেদী হাসানের ভবিষ্যৎ অালোকিত করার। তাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার। যাদেরকে এক বছর অার তিন বছর বয়সে রেখে মা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তারপর পাঁচ বছরের মাথায় একমাত্র ভরসা বাবাও চলেন না ফেরার দেশে।
এরপর ছোট দুই ভাইয়ের জন্য অবিরাম ছুটে চলা। সকল দুঃখের গ্লানি মুছে তাদের কথা ভেবে একটি সরকারি চাকরির অাশায় পড়ালেখার জন্য ধুলোমাখা গ্রামের মায়া ছেড়ে স্বজনদের হাত ধরে এসেছিলেন শহরের নিষ্ঠুরতার ভিড়ে। যে শহর রাত-দিন অবিরত ছুটে চলে হিংস্রতার দাবানলে। যে দাবানল পুড়িয়েছে সহস্র স্বপ্ন। নিভিয়ে দিয়েছে সহস্র তরুণের মশালের অালো। সেই শহর রাজীবের ছোট্ট স্বপ্নটিও কেড়ে নিতে শঙ্কাবোধ করেনি। এ শহরের হিংস্রতায় সব পূর্ণতা হারিয়ে রাজীব এখন ভাসছে শূন্যতায়। ছোট দুই ভাইকে নিয়ে দেখা তার ছোট্ট সেই স্বপ্নটিও থমকে অাছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের অাইসিইউর চার দেয়ালে।
বলছিলাম গত ৩ এপ্রিল দুপুর ৩টার দিকে রাজধানীর কাওরানবাজার সংলগ্ন সার্ক ফোয়ারার পাশে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন নামে দুই বাসের হিংস্র প্রতিযোগিতায় হাত হারানো রাজীবের কথা। যে প্রতিযোগিতা মুহূর্তেই কেড়ে নিয়েছে রাজীবের বেঁচে থাকার অবলম্বন, স্বপ্ন গড়ার হাতিয়ার ডান হাতটি। এরপর তার বিচ্ছিন্ন হাতসহ তাকে নেয়া সমরিতা জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে ঢামেকে। কিন্তুু কোথাও অার সম্ভব হয়নি বিচ্ছিন্ন হাত জোড়া লাগানো। তাই হাত জোড়া লাগাতে না পারলেও সে সুস্থ হয়ে স্বজনদের মাঝে ফিরে অাসুক এটিই ছিল সবার প্রত্যাশা।
মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ঢামেকের অাইসিইউতে শুরু হয় তার চিকিৎসা। ক্রমেই সে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগছিল। কিন্তুু রাজীব হাত হারালেও ওই সময় মাথায় প্রচণ্ড অাঘাত পাওয়ায় মস্তিষ্কের সামনের অংশে রক্ত ও পানি জমে যায়। এতেও সে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছিল। চিকিৎসকরাও প্রত্যাশা করেছিলেন সে সুস্থ হয়ে উঠলেই তার মস্তিষ্কে জমে থাকা রক্ত ও পানি সরাতে অস্ত্রোপচার করবেন। টানা পাঁচদিন চিকিৎসার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গত ৯ এপ্রিল চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পরের দিন অর্থাৎ ১০ এপ্রিল তাকে অাইসিইউ থেকে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করবেন। কিন্তুুু তার অাগেই সবাইকে শঙ্কায় রেখে রাজীবের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১০ তারিখ সকালে ওয়ার্ডে অার নেয়া হয়নি রাজীবকে। সকাল ৮টায় তাকে নিতে হয়েছে লাইফ সাপোর্টে। এরপর টানা ৪০ ঘণ্টা (এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) পার হলেও তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই।
মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা বলছেন, রাজীবের মস্তিষ্ক এখন কাজ করছে না। শুধু নিশ্বাস নিচ্ছে। তারা বলছেন, মেডিকেলের ভাষায় স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষের গ্লাসগো কোমা স্কেল অর্থাৎ সজ্ঞানতার অবস্থা (জিসিএস) ১৪-১৫ থাকে। কিন্তু এটি যখন আটের নিচে নেমে আসে তখন রোগীর অবস্থাকে ক্রিটিক্যাল বলা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে রাজীবের জিসিএস অবস্থান এখন তিনের কোটায়। অর্থাৎ অাটের নিচে। যেটি ক্রিটিক্যাল বলে প্রমাণিত হয়।
চিকিৎসকদের ধারণা, যখন কোনো মানুষের জিসিএস তিনের নিচে চলে যায় তখন মানুষটি আর বেঁচে থাকে না। এখন সে অনুযায়ী রাজীবের অবস্থা বলা মুশকিল। তবে আল্লাহ পাকের রহমতে রাজীব সুস্থ হবেন এ অাশা চিকিৎসক ও স্বজনদের।
রাজীব ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। এ জন্য ছোট বেলা থেকেই সহপাঠীরা বলতো তাকে ডাক্তার হতে। তারও স্বপ্ন ছিল এটি। কিন্তুু সময়ের বিবর্তনে মা-বাবাকে হারিয়ে অসহায় রাজীব সেই স্বপ্নকে অার ধরে রাখতে পারেননি। একদিকে অর্থাভাব অন্যদিকে অসহায় ছোট দুটি ভাই। সব কিছু মিলিয়ে রাজীব নিজের স্বপ্ন ত্যাগ করে ছোট ভাইদের জন্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
তিনি পটুয়াখালীর বাউফলের ফজলুল হক কলেজে ইংরেজি বিভাগে স্মাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন। এখান থেকে গ্র্যাজু্য়েশন শেষ করতে অারও তিন বছর লাগবে। কিন্তুু এতদিনে নিজের এবং ছোট ভাইদের চালানোর মতো অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল হবে। এ চিন্তা করে দ্রুত একটি ডিগ্রি নিয়ে সরকারি চাকরির অাশায় ভর্তি হয়েছিল রাজধানীর শহীদ তিতুমীর কলেজে। সেখানেও সে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন। অার এক বছর পর পরীক্ষা শেষে একটা চাকরি নেয়ার অাশায় ছিলেন। কিন্তুু তার অাগেই তার সব অাশা নিরাশায় পরিণত হলো।
মা-বাবাকে হারিয়ে ছোট দুই ভাই মেহেদি হাসান ও অাবদুল্লাহর বেড়ে ওঠা, সেই সঙ্গে স্বপ্ন পূরণের ভরসা হয়ে উঠেছিলেন রাজীব। কিন্তুু যার মাঝে তারা খুঁজে পেয়েছিল মা-বাবাকে হারিয়ে নিঃসঙ্গতার মাঝে স্বাচ্ছন্দ্যবোধের প্রতিচ্ছবি সেই রাজীবকে নিয়ে ফের শঙ্কায় তারা। না জানি বাবা-মায়ের মতো বড় ভাই রাজীবও তাদেরকে ছেড়ে চলে যায়। এ শঙ্কায় অাইসিইউর সামনে তাদের অপেক্ষাগুলো ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। সেই সঙ্গে রাজীবের স্বজনরাও তার অপেক্ষায় নির্ঘুম প্রহর গুণছেন অাইসিইউর সামনে।
রাজীবের ছোট ভাই মেহেদী জাগো নিউজকে বলেন, গত পরশু দিন রাত সাত ৮টার দিকে খালার সঙ্গে ভাইয়াকে দেখতে অাইসিইউতে গিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়ার পর ভাইয়া অামাকে দেখে বলে "কিরে তুই এখানে কেন, তুই পড়তে যাস না!" এটা বলার পর অামি কিছুই বলতে পারিনি, সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে ডাক্তাররা অামাকে বাহিরে যেতে বলেন। অার বলেন, কাল সকালে তাকে ওয়ার্ডে নেবে। তখন বেশি করে কথা বলতে পারবে। কিন্তুু সকালে কথা বলার অাগেই ভাইয়্যাকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে গেছে..! এ কথাগুলো বলার পর মেহেদী অার কোনো কথা বলতে পারেননি। মনে হল যেন, তার কণ্ঠ ভারি হয়ে অাসছে অার ছলছল করছিল তার দুচোখ অশ্রুর নোনা জলে।
এ সময় তার খালা জাহানারা অাইসিইউর সামনে অসুস্থ শরীর নিয়ে রাজীবের অপেক্ষায় শুয়েছিলেন। জাহানারার ছোট বোন হ্যাপী জাগো নিউজকে বলেন, রাজীবকে অামার অাপা ছোট বেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। তার ছেলে-মেয়েদের চেয়ে রাজীবকে বেশি অাদর করতেন। রাজীব ছিল অামার বোনের হাতের লাঠি। কিন্তুু রাজীবের এই অবস্থা গত এ সপ্তাহ ধরে অামার অাপা অাইসিইউর সামনে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। তাই তিনি অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এসএইচ/বিএ