জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রাজীব : দোয়া চেয়েছেন স্বজনরা
‘রাতে (সোমবার দিবাগত রাতে) আমাদের রাজীবের কী হলো আল্লায় জানে। সন্ধ্যায় তার সঙ্গে কথা বলে বাসায় গিয়েছিলাম। গভীর রাতে শুনি তার অবস্থা ভালো না। একথা শুনে নিজের কাছে কেমন লেগেছে তা কাউকে বুঝাতে পারব না। মনে হয়েছে কেউ বুঝি কলিজাটা চেপে ধরেছে। যে রাজীব চোখ মেলেছে, একটু একটু কথা বলেছে, যাকে রাত পোহালেই আইসিইউ থেকে ওয়ার্ডে নেয়ার কথা ছিল, সেই এখন লাইফ সাপোর্টে। এটা কেমনে মেনে নিই বলেন…?’
বুকভরা আর্তনাদ আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জাগো নিউজের কাছে এভাবেই অপ্রত্যাশিত মুহূর্তগুলোর বর্ণনা দিচ্ছিলেন রাজীবের মেঝ খালা হ্যাপী আক্তার। তার এমন শোকাবহ শব্দগুলো আইসিইউর সামনে অবস্থানরত অন্য স্বজনদের মুহূর্তেই যেন শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেয়। সৃষ্টি করে হৃদয়ের মাঝে নীরব রক্তক্ষরণ।
তিনি বলেন, ‘রাজীবের ব্যাপারে গতকাল (সোমবার) দুপুরের দিকে হাসপাতালের পরিচালকের সঙ্গে আমরা সবাই গিয়ে কথা বলি। সে আগের চেয়ে সুস্থ আছে বলে তিনি আমাদের জানান। এমনকি আজ (মঙ্গলবার) সকালে তাকে ওয়ার্ডে স্থানান্তরের কথাও বলেছিলেন পরিচালক। অথচ সকালে তাকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে গেল। এটা কেমনে মেনে নেব। এটা আমরা কেউ আশা করিনি।’
এ সময় শোকাবহ পরিবেশে রাজীবের বড় খালা জাহানারা ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে এ প্রতিবেদককে বলেন, গতরাতে আমরা তার অবস্থা অনেকটা ভালোর দিকে দেখেছিলাম। আজ (মঙ্গলবার) সকালে তাকে ওয়ার্ডে নেয়া হবে এ আশায় বাসায় যাই। কিন্তু গতকাল দিবাগত রাত পৈানে ৪টার দিকে তার অবস্থা খারাপ হলে সকাল ৮টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয় চিকিৎসকরা।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রাজীবের এমন অবস্থা নিয়ে এখন তারা সবাই শঙ্কিত বলে জানান তিনি। এ জন্য দেশবাসীর কাছে রাজীবের সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছেন জাহানারা বেগম।
রাজীবের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শামসুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘তার (রাজীব) অবস্থা এখন সঙ্কটাপন্ন। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। বাকিটা আল্লাহর ওপর নির্ভর করছে।’
তিনি বলেন, মেডিকেলের ভাষায় স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষের গ্লাসগো কোমা স্কেল অর্থাৎ সজ্ঞানতার অবস্থা (জিসিএস) ১৪-১৫ থাকে। কিন্তু এটি যখন আটের নিচে নেমে আসে তখন আমরা রোগীর অবস্থাকে ক্রিটিক্যাল বলে থাকি। সেক্ষেত্রে রাজীবের জিসিএস অবস্থান এখন তিনের অধিক কিন্তু আটের নিচে। যখন জিসিএস তিনের নিচে চলে যায় তখন মানুষটি আর বেঁচে থাকে না। এখন সে অনুযায়ী রাজীবের অবস্থা বলা মুশকিল। আল্লাহ পাকের রহমত ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না এমতাবস্থায়।
ঢামেক আইসিইউয়ের সামনে রাজীবের মেঝ খালা হ্যাপী আক্তার
তিনি আরও বলেন, মাত্র একদিনের ব্যবধানে রাজীবের সিটিস্ক্যান রিপোর্টে অনেক ব্যবধান দেখা দিয়েছে। গতকাল (সোমবার) রিপোর্টে যে তথ্য আসে সেই তথ্যের সঙ্গে আজকের (মঙ্গলবার) রিপোর্টের তথ্যের কোনো মিল নেই। অনেক ব্যবধান দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তার মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ কিছু একটা ঘটেছে।
রিপোর্টের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, তার মস্তিষ্কের সমস্যার পাশাপাশি চোখের সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তার চোখের লাইটিং প্যারামিটারের অবস্থা ভালো না।
এদিকে আজ (মঙ্গলবার) দুপুরে রাজীবকে হাসপাতালে দেখতে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া। তিনি আইসিইউতে গিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা রাজীবের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন ও চিকিৎসার বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
তিনি জানান, রাজীবের এমন অবস্থায় এখন কোনো অস্ত্রোপচার করা হবে না। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ( ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকদের দেয়া টিকিৎসাপত্রে অারও কিছু ওষুধ যোগ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে অাগামীকাল (বুধবার) সকাল অবধি তাকে পর্যবেক্ষণ করা হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৩ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। বাসটি হোটেল সোনারগাঁওয়ের বিপরীতে পান্থকুঞ্জ পার্কের সামনে পৌঁছালে হঠাৎ পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে গা ঘেঁষে অতিক্রম করে। এ সময় দুই বাসের প্রবল চাপে গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এতে তার মাথায়ও প্রচণ্ড আঘাত লাগে।
দুর্ঘটনার পর তাকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতালে ও পরে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
এসএইচ/জেডএ/বিএ