স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে চট্টগ্রাম
সাগর, পাহাড় আর নদীর মিতালী বন্দরনগরী চট্টগ্রাম যেন প্রকৃতির রাজধানী। শত শত বছরের ব্যবসায়িক ঐতিহ্য এনে দিয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানীর তমকা। তবে অদৃশ্য কারণে রূপকথার ‘সুয়ো রানী-দুয়ো রানী’র গল্পের মত বারবার অবহেলিত হয়েছে বীর সূর্যসেনের চট্টগ্রাম। এবার সেই অবহেলিত তকমা থেকে বের হয়ে আসছে বন্দরনগরী।
নগরীর ওয়াসা মোড় থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (ফ্লাইওভার) এখন আর স্বপ্ন নয়। তিন বছরের মধ্যে এ ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে বলে আশা করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। শিগগিরই শুরু হচ্ছে কর্ণফুলী টানেলের কাজও। সব মিলিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দুয়ারে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নে আন্তরিক। দীর্ঘদিন উন্নয়নের ছোঁয়া বঞ্চিত চট্টগ্রামে এরই মধ্যে বড় একটি ফ্লাইওভারসহ বেশ কিছু উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার পথে। এসব উন্নয়ন কাজ এখন দৃশ্যমান। এর আগেও হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন করা হলেও জলাবদ্ধতা সব অর্জন নষ্ট করে দিয়েছে। তবে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সেই বাধাও অনেকটাই কেটে যাবে।
এছাড়া দৃশ্যমান উন্নয়ন কাজের মধ্যে রয়েছে ফ্লাইওভার ও ওভারপাস নির্মাণ। এসব প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ হলে আগামী পাঁচ বছরে পঞ্চাশ বছর এগিয়ে যাবে চট্টগ্রাম। তবে পরিকল্পিতভাবে এসব উন্নয়নকাজ এখন শেষ করাটাই সময়ের দাবি।
কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ হলে চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। চট্টগ্রামকে আরও আধুনিক একটি শহরে পরিণত করবে এ টানেল। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড় থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত দক্ষিণ চট্টগ্রামে আগামী পাঁচ বছরে এক লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হবে বলে জানা গেছে।
সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার মূল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ৯টি পয়েন্টে ১২ কিলোমিটারসহ মোট ২৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। চার লেনের এ প্রকল্পের প্রস্থ ৬০ ফুট। ফ্লাইওভারটির ৯টি জংশনে (স্টেশন) ২৪টি র্যাম থাকবে।
টাইগারপাস মোড় থেকে নিউমার্কেটের দিকে ওঠা-নামার সুযোগসহ র্যাম, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড়ে, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে স্ট্র্যান্ড রোডে যাওয়া-আসা, নিমতল বিশ্বরোড মোড় থেকে পোর্ট কানেকটিং রোডে ওঠা-নামা, কাস্টমস মোড়ে ওঠা-নামা, সিইপিজেড মোড়ে ওঠা-নামা, কর্ণফুলী ইপিজেড মোড়ে ওঠা-নামা, কাঠগড় মোড়ে ওঠা-নামা, সি-বিচ মোড়ে ওঠা-নামা এবং সর্বশেষ বিমানবন্দরে ওঠা-নামার সুযোগ থাকবে।
প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান বলেছেন, প্রকল্পটির কাজ শিগগিরই শুরু হবে। তিন বছরের মধ্যে এই ফ্লাইওভারের কাজ শেষ করা যাবে বলে আশা করছি।
এছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগাপ্রকল্প, মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত ফ্লাইওভার, লালখানবাজার থেকে বিমাবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সিটি আউটার রিং রোড, বায়েজিদ থেকে ফৌজদার হাট বাইপাস রোড, বাকলিয়া এক্সেস রোড, অনন্যা আবাসিকসহ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দশটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল বাজেটের ওয়াসা মোড় থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ফ্লাইওভার প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। এটি বাস্তবায়িত হওয়ার পর পুরো নগরীর যাতায়াত ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। নির্মাণের পর ফ্লাইওভারের ইলেক্ট্রনিক টোল থাকবে। তবে কোথায় কীভাবে টোল নির্ধারণ করা হবে, তা পরে চূড়ান্ত করা হবে।
এছাড়া নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত চিটাগাং সিটি আউটার রিং রোডের নির্মাণ কাজ প্রায় ৭৫ ভাগ শেষ হয়েছে। ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩৩ ফুট উচু সড়কটি চালু হলে নগরবাসী যানজটের যন্ত্রণা থেকে অনেকটা মুক্তি পাবে বলে আশা করছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ। চলতি মাসে (এপ্রিল) রিং রোডটি পরীক্ষামূলকভাবে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে জানান সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম।
গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় সাগর-নদী পরিবেষ্টিত চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষার জন্য স্লুইচ গেট নির্মাণ, খাল খনন ও পাম্প মেশিন দিয়ে পানি সেচসহ নানা কর্মযজ্ঞ রয়েছে। ফলে চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতা থেকে শিগগিরই মুক্তি পাবেন।’
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের চুক্তি সই অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম গতকাল সোমবার (৯ এপ্রিল) বলেন, ‘২০০৮ সালের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে পদ্মা সেতুর পর চট্টগ্রামে একক বৃহৎ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়নে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার প্রকল্প এরই একটি অংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নগরীর দুঃখখ্যাত জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে।’
আরএস/জেআইএম