সাংবাদিক ফয়সাল আর নেই, মানতে পারছেন না সহকর্মীরা
উচ্ছ্বল তরুণ, সব সময় হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। নরম সুরে কথা বলা, সবাইকে আপন করে নেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ও কাজ পাগল মানুষটির নাম ফয়সাল আহমেদ। দুর্ঘটনায় এভাবে চলে যাবেন কেউ মেনে নিতে পারছেন না। মৃত্যু হয়েছে জেনেও সহকর্মীরা আবেগাপ্লুত হয়ে বলছেন ‘তিনি এখনও জীবিত’। হাস্যোজ্জ্বল মুখে আবারো অফিস মাতাবেন, আশায় আছেন তার সহকর্মীরা।
সোমবার নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। সেই বিমানে ছিলেন বৈশাখী টেলিভিশনের প্রতিবেদক ফয়সাল আহমেদ।
বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক (সিএনই) ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সবসময় হাসিখুশি ছিল ফয়সাল। অফিসের সব ধরনের অনুষ্ঠান একাই মাতিয়ে রাখতো সে। তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটি যে কোনো সময় সবাইকে মুখরিত করে তুলতো। দুর্ঘটনায় তার করুণ পরিণতির বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছি না। এ মুহূর্তে তার মৃত্যুর খরবটাও প্রকাশ করতে পারছি না। আমরা আশায় আছি, ফয়সাল ফিরে আসবে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে ২০১২ সালের ৯ মে বৈশাখী টেলিভিশনে যোগদান করেন। দুই বছর কাজ করেন এ পদে। কিন্তু ফয়সালের স্বপ্ন ছিল রিপোর্টিংয়ে কাজ করবে। এ আগ্রহের কথা সব সময় বলতো সে। তাই ২০১৪ সালের মে মাসে তাকে ছয় মাসের জন্য রিপোর্টিংয়ে কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয়। নিজ যোগ্যতায় অল্প সময়ে রিপোর্টার হিসেবে আস্থা অর্জন করেন। নির্ভরশীল রিপোর্টার হিসেবে তাকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে স্পর্শকাতর জায়গা প্রধানমন্ত্রীর বিটে রিপোর্টিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।
তিনি বলেন, সব কাজেই ফয়সাল ছিল মনযোগী। ছিল খুবই যত্নবান। আর রিপোর্টিং করা ছিল তার নেশা। তাই হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়ালেখা করেও মিডিয়ায় সফল হয়েছিলেন তিনি।
ফয়সালের সঙ্গে শেষ স্মৃতি কথা বলতে গিয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রীর বিটের রিপোর্টারদের পিকনিকেও ছিল সে। পুরো পিকনিক মাতিয়েছে। পরে র্যাফেল ড্রতে প্রথম পুরস্কার ৪০ ইঞ্চি টিভি পান ফয়সাল। কীভাবে টিভি নিবে বাসায়। পরে রাত্রে আমি তার ধানমন্ডি বাসায় পৌঁছে দেয়।
প্রতিষ্ঠানটির এ প্রধান বার্তা সম্পাদক বলেন, ফয়সাল পাঁচদিনের ছুটি নিয়েছিল। তবে নেপালে গেছেন, সেটি আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানতাম না। দুর্ঘটনার পর খবর পাই তিনি নেপালে গেছেন। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত আহত-নিহত ব্যক্তিদের তালিকা দেখে জানতে পারি, ফয়সালের নাম সেখানে আছে।’ তবে পাসপোর্ট নম্বর মিলিয়ে নিশ্চিত হই ওই ফয়সালই আমার সহকর্মী ফয়সাল।
ফয়সাল আহমেদ ১০ অক্টোবর ১৯৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর।
ফয়সালের সহকর্মী বৈশাখী টেলিভিশনে প্রতিবেদক সাঈদ খান বলেন, অফিসে আমার ডেক্সের সামনেই ফয়সাল বসতো। ও যতক্ষণ অফিসে থাকতো সব সময় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতো। ছোট-বড় সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতো। তার কোনো শত্রু ছিল না। অফিস সহকর্মী হিসেবে অনেক কথাবার্তায় মান অভিমান হত। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সে বিষয়টিকে সহজ করে নিত। সবাইকে ভুলিয়ে দিত। সব সময় নরম সুরে কথা বলতো। আজ ওকে নিয়েই নিউজ করবো এটা ভাবতে পারছি না। ফয়সাল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এটা এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। খুবই কষ্টকর।
এদিকে সহকর্মীর দুর্ঘটনা খবর পড়তে গিয়ে বৈশাখী টিভির উপস্থাপিকা রুমানা আফরোজ আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে খবর পড়েন তিনি।
আরেক সহকর্মী নাজমুল সাঈদ বলেন, আমরা শুধু ফয়সাল ভাইকে হারাইনি একজন ভালো মানুষকে হারিয়েছে। সহকর্মী হিসেবে নয় তাকে বড় ভাই হিসেবে জানতাম। সে মানুষকে স্বপ্ন দেখাতো।
নাজমুল বলেন, ফয়সাল ভাইয়ের সঙ্গে অনেক ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করতাম। তিনি সবসময় অনুপ্রেরণা দিতো। সামনে এগিয়ে চলার পরামর্শ দিতো।
এদিকে অশ্রু ভেজা চোখে প্রতিষ্ঠানটির গার্ড সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ফয়সাল স্যার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বিশ্বাস করতে পারছি না। ভালো মানুষগুলো তাড়াতাড়ি চলে যায়।
ফয়সালের কথা বলতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান চিত্র সম্পাদক সেলিম সারোয়ার রিপন অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকেন। সহকর্মী বন্ধু হারানোর চাপা কষ্টে নিয়ে তিনি বলেন, কি বলবো?
কিছুক্ষণ পরে তিনি বলেন, দুঃখজনক। হাস্যোজ্জ্বল মুখটি আর দেখবো না। অফিস একটি পরিবারের মতো। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের সঙ্গে কাটিয়েছে। কালকে যখন তার রঙিন ছবিটি সাদাকালো করতে বলে আমাকে। আমি শেষ পর্যন্ত করতে পারিনি। এখনও আশায় আছি ফয়সাল আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে।
এসআই/জেএইচ/আরআইপি