ঈদকে ঘিরে নিভে গেল তিনশতাধিক প্রাণ
ঈদে গত এক সপ্তাহে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনশতাধিকের মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এখনো সড়কপথের এই লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সারাদেশে অন্তত দুইশ পরিবারের ঈদের আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে এই সড়ক দুর্ঘটনা। কিছুতেই কমছে না এই মৃত্যুর সংখ্যা। বরং এই মৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিনই যোগ দিচ্ছে অগণিত তরতাজা প্রাণ।
জাগো নিউজের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধি, নিজস্ব প্রতিবেদক ও জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকদের তথ্য অনুযায়ী গত সাত দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রায় তিনশতাধিক মানুষ। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন প্রায় এক হাজারের মতো।
এদিকে শুক্রবারও সারাদেশে প্রায় অর্ধশত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। সর্বশেষ (শুক্রবার) বেলা আড়াইটায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় মিরপুরগামী একটি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় মো. সোহেল রানা নামে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কনস্টেবল নিহত হয়েছেন।
অন্যদিকে, রাজধানীর ভাটারা থানাধীন কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় বাস উল্টে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একটি দ্রুতগামী বাস ডিভাইডারে ধাক্কা লেগে উল্টে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই অজ্ঞাতনামা এক যাত্রী নিহত হন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। পথচারীরা তাদের উদ্ধারের পর বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পাঠিয়েছেন।
এছাড়া রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের মুখে ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী মজিবর রহমান (৩০) নিহত হয়েছেন। গাজীপুরের নাওজোড় চৌরাস্তা এলাকায় লেগুনা ও কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচজনে পৌঁছেছে। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন লেগুনার আরো ৯ যাত্রী। শুক্রবার সকাল সোয়া ৮টায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
কাঁচপুর ব্রিজে সড়ক দুর্ঘটনায় মুজিবর রহমান (৫৩) নামে আরেক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরো একজন আহত হয়েছেন। বেলা ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। মুজিবর কেরানীগঞ্জের কালিন্দী এলাকায় বসবাস করতেন।
মাদারীপুরের ডাসারে একটি লোকাল বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে ডাসার থানাধীন পাথুরিয়া এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
একই দিনে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার সোহাগপুর এলাকায় ঢাকা থেকে গাইবান্ধাগামী যাত্রীবাহী একটি বাস খাদে পড়ে দু’জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার গাজীপুরের হায়দ্রাবাদে ডেমু ট্রেনের ধাক্কায় একই পরিবারের ৬ জনসহ মোট আটজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবার বাড়ি নরসিংদী জেলায়।
এর আগে রোববার ভোরে বঙ্গবন্ধু সেতুর সংযোগ মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মূলিবাড়ী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় বাসচালকসহ ১৭ জন নিহত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জের এই দুর্ঘটনাসহ ঈদের আগের দিন শুক্রবার থেকে সোমবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরো কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সিরাজগঞ্জ কার্যালয় থেকে জানা গেছে, দুর্ঘটনা কবলিত বাস দু’টির কোনোটিরই রুট পারমিট ছিল না। এছাড়া সাবির পরিবহনের ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদ ২০১৪ সালের এপ্রিলে শেষ হয়েছে। ফিটনেসও ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তারপরও বাসটি চলাচল করছিল।
পটুয়াখালীতে ঈদের দিন পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় চারজনের মৃত্যু হয়। একই দিন পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় কুমিল্লায় বাবা-ছেলেসহ তিনজন মারা যান। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে বাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান দু’জন। কুষ্টিয়ায় নিহত হয় এক কিশোর। ঈদের পরের দিন বিকেলে রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কের উত্তম মুচির মোড় এলাকায় অটোরিকশা থেকে ছিটকে পড়ে নিহত হয় এক শিশু।
এছাড়া মাদারীপুরের শিবচরে বাস খাদে পড়ে একজন, নওগাঁয় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এক কিশোর, ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাসচাপায় প্রাইভেটকারের তিন আরোহী, বগুড়ার শেরপুরে ট্রাকের চাপায় এক নারী, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। মুন্সিগঞ্জে গত তিন দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন।
এছাড়া কুমিল্লা ও বুড়িচং, সাভার, নড়াইল, নীলফামারী, চন্দনাইশ ও চট্টগ্রাম, যশোর, মুন্সীগঞ্জ, পাবনার সুজানগর, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, নাটোর, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, নওগাঁ, বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরো শতাধিক মানুষ মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য মতে, ৯১ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে অদক্ষ চালকদের কারণে। এছাড়াও পথচারীদের অসতর্কতা, লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও মালিকপক্ষের নানা অব্যবস্থাপনার কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। আর অধিকাংশ দুর্ঘটনায় গাড়ির চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে অনিয়ম থেকেই যাচ্ছে। বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও এসব দুর্ঘটনার জন্য চালকদের দায়ী করেছেন। মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জের মুলিতবাড়িতে সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেন, সড়কের ত্রুটি নয়, চালকের দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো এবং ওভার টেকিংয়ের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান বের করবেন বলেও নিহতদের পরিবারকে আশ্বাস দেন তিনি।
আরএম/একে/এমএএস/পিআর