ক্যান্সারের চিকিৎসার নামে চলছে বাণিজ্য
দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার নামে অপবাণিজ্য চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে হেড-নেক ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। মোট রোগীর সংখ্যা কতো এ সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদফতরে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও নেই।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা প্রতি তিনজন রোগীর মধ্যে একজন হেড-নেক ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে।
তারা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে শতকরা ৯০ ভাগ ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব হলেও জনসচেতনতার অভাবে সিংহভাগ রোগী ক্যান্সারের শেষ ধাপ নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসে। কিন্তু সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল কোথাও তারা সম্পূর্ণ সুচিকিৎসা পান না।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, হেড ও নেক ক্যান্সার রোগীদের সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি এ তিন ধরনের ধারাবাহিক চিকিৎসার গ্রহণ করতে হয়।
সরকারি হাসপাতালে সার্জারি চিকিৎসাটুকু মিললেও পরবর্তী রেডিওথেরাপি চিকিৎসার জন্য দুই থেকে তিন মাসে অপেক্ষা করতে হয়। লম্বা সিরিয়ালের কারণে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে রোগীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
অপরদিকে বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। প্রতিবেশি দেশ ভারতে ক্যান্সার নির্ণয়ে পিইটি সিটি স্ক্যান পরীক্ষা মাত্র ১৫ হাজার টাকায় করা সম্ভব হলেও বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা আদায় করা হয়।
জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সরকারিভাবে কোনো নিয়মনীতি বা ফি নির্ধারিত না থাকায় ক্যান্সার নির্ণয় পরীক্ষার নামে জমজমাট বাণিজ্য চলছে বলে অভিযোগ করেন সেবা নিতে আসা রোগীরা।
আগামী ২৭ জুলাই বিশ্ব হেড-নেক ক্যান্সার দিবস-২০১৫ এর প্রাক্কালে বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) বাংলাদেশ সোসাইটি অব হেড-নেক সার্জনস আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একাধিক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞসহ ও হেড-নেক সার্জনদের মুখে ক্যান্সার চিকিৎসার দুরবস্থার কথা উঠে আসে।
সোসাইটির সভাপতি ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী বলেন, মুখ, নাক, সাইনাস, মুখ গহ্বর, শ্বাসনালী ও খাদ্যনালীর উপরিভাগ ও গলার ক্যান্সারসহ থাইরয়েড গ্রন্থি, বিভিন্ন লালাগ্রন্থি ইত্যাদি ক্যান্সারসমূহ হেড-নেক ক্যান্সারের অন্তর্ভুক্ত।
তিনি বলেন, জিহ্বা ও গলার কোনো ঘা যদি দুই সপ্তাহের মধ্যে ভালো না হয় তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। গলায় কাঁটা লাগা, স্বর ভঙ্গা, খাবার গিলতে অসুবিধা হওয়া, নাক থেকে সর্দির সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, নাক, কান ও গলার কোনো অংশ ব্যথাহীনভাবে ফুলে থাকা ইত্যাদি এ রোগের উপসর্গ।
সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুল হাসান জানান, ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দ্দা, গুল, সাদা পাতা ও খৈণী) মুখের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের হেড নেক ক্যান্সারের মূল কারণ। এ ছাড়া সিগারেট, বিড়ি, মদ পান, দাঁতের যত্ন না নেয়ার কারণেও মুখের ক্যান্সার হয়।
তিনি বলেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগে থেকেই হেড-নেক ক্যান্সারের কারণগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে। পরিবারের একজন সদস্যের ক্যান্সারের ফলে গোটা পরিবার মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন বলেন, সরকারি বেসরকারি উভয় পর্যায়ে রেডিওথেরাপি মেশিনের স্বল্পতা রয়েছে। সারাদেশে সরকারি পর্যায়ে ৯টি ও বেসরকারি পর্যায়ে ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা চলে।
প্রতি ১০ লাখ রোগীর জন্যও যদি একটি করে রেডিওথেরাপি মেশিন প্রয়োজন হয় তবে মোট ১৬০টি মেশিন প্রয়োজন হয়। সেখানে সব মিলিয়ে মেশিনের সংখ্যা মাত্র ১৫টি। ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে সময়মতো সুচিকিৎসা প্রদান করা যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ ২০ গুণ বেশি বলেও জানান তিনি।
বিএসএমএমইউ-এর মেক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান বলেন, হেড-নেক বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই ঢাকায় অবস্থান করায় তৃণমূল পর্যায়ে কর্তব্যরত এমবিবিএস বা ডেন্টাল চিকিৎসকরা হেড-নেক ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, স্নাতক পর্যায়ে চিকিৎসা শিক্ষা কোর্সে ক্যান্সার সম্পর্কে খুব বেশি পড়াশুনা না থাকায় কিংবা চাকরিতে ঢোকার পর এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভের সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ রোগী সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে বিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে আসে। ততক্ষণে আর কিছুুই করার থাকে না।
বিএসএমএমইউ-এর নাক, কান ও গলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার বলেন, ক্যান্সার রোগের সার্জারির চিকিৎসায় বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। তবে রোগীর সংখ্যানুপাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা অপ্রতুল।
নাক, কান ও গলা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান তরফদার বলেন, দেশে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসার নামে বাণিজ্য চলছে। সরকারিভাবে কোনো নিয়মনীতি না থাকায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো ইচ্ছে মাফিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। এ ব্যাপারে নীতিমালা এখন সময়ের দাবি বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব হেড-নেক সার্জনস সভাপতি অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএসএমএমইউর ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবু শফি আহমেদ আমিন, অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলম তালুকদার, বিএমএ’র সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সোসাইটির কোষাধক্ষ্য ডা. মো. মোসলেমউদ্দিন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, আর্থিক সংকটের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে গভীর রাতে প্রচার অযোগ্য বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। মানুষের সুক্ষ্ণ অনূূভূতিতে আঘাত করে মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের নিশ্চিত সুচিকিৎসার সহজ উপায়, বিশেষ উপায়ে নারী ও পুরুষের যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশ বিদেশে ভালো চাকরি পাইয়ে দেয়ার মতো অবিশ্বাস্য সব বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। আমি তাদের বলেছি না পোষালে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে।
তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও আগুনে মানুষ পোড়ানোর উস্কানিদাতারা সমাজের ক্যান্সার। ক্যান্সার হলে একজন চিকিৎসক যেমন যেমন সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার করেন তেমনি সমাজে যারা ক্যান্সার ছড়াচ্ছে তাদের দমন ও ধ্বংস করতে তিনি ভিন্ন ধরণের অস্ত্রোপচার করছেন।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে হেড-নেকসহ বিভিন্ন ক্যান্সারের কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা সুবিধা ও সমস্যা সম্পর্কে সহজবোধ্য ভাষায় বুঝিয়ে বলতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএসএমএমইউ ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সন্তোষজনক। শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ দেশের সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিচ্ছে। মাত্র এক ভাগ মানুষ বিদেশে যাচ্ছে।
তিনি অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হাসানুল হক ইনুকে বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো হওয়ার পরও মন্ত্রী, সাংসদ ও রাজনীতিবিদরা বিদেশে গেলে তারা বিব্রত হন। তিনি মন্ত্রীদের বিদেশ না যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আপনারা বিদেশে যাবেন না, আপনাদের সুচিকিৎসার সকল দায়িত্ব আমরা নেবো।
এমইউ/এসকেডি/বিএ/আরআইপি