ঈদে বাড়ি ফেরার সৌভাগ্য হবেনা দগ্ধ রোগীদের
ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন অ্যান্ড প্লাষ্টিক সার্জারি ইউনিটের রোগীদের ঈদ উপলক্ষে বাড়ি ফেরা হবে না। বছর খানেক আগে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে হাসি খুশিতে ঈদ করলেও এবারের ঈদে সকলের চেহারায় বিষাদের কালো ছায়া। অধিকাংশ হৃতদরিদ্র রোগীরা ধার দেনা করে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কথা হয় বর্ন ইউনিটের তৃতীয় তলার বারান্দায় গত দেড় মাস যাবৎ চিকিৎসাধীন দগ্ধ রোগী নাসিরউদ্দিন (২৬) সঙ্গে। তিনি জানান, দৈনিক ৩৫০টাকা বেতনে রড মিস্ত্রির হেলপারের কাজ করতেন।
রাজধানীর কাওলায় একটি চারতলা বাড়িতে রড টেনে তুলতে গিয়ে অসতর্কতামূলকভাবে বৈদ্যুতিক তারের সঙ্গে রড লেগে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হন। গত দেড়মাসে দু দফা অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। পোড়ার ক্ষত সারাতে হাত ও পায়ের কয়েকটি আঙ্গুল ও বুকের হাড় কাটতে হয়েছে।
শুক্রবার সকালে সরজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় নাসিরউদ্দিনের দুই হাত, পা ও বুক সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। বিছানায় লম্বা সটান হয়ে ঘুমাচ্ছে। বেডের নীচে মাদুরে শুয়ে আছে তার দুই বছরের শিশু কন্যা মরিয়ম। বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বড় মেয়ে শিরিন(৭) ও স্ত্রী।
ঈদে বাড়ি যাবেনা, শিরিনকে এ প্রশ্ন করতেই কান্নাজড়িত কন্ঠে মেয়েটি বললো, বাবারে রাইখ্যা বাড়িত ভালা লাগেনা, আমরা হগলেই বাবার লগে হাসপাতালেই ঈদ করুম।
শুধু নাসিরউদ্দিন, তার স্ত্রী বা মেয়েরাই নয়, তাদের মতো আরো অনেক এ ধরণের রোগী ও স্বজনদের বাড়ি ফেরার সৌভাগ্য হবেনা, হাসপাতালের চৌহদ্দিতেই কাটবে তাদের ঈদ।
টাঙ্গাইল বাসাইল পাহাড় সখীপুর গ্রামের ২২ বছরের তরুন রং মিস্ত্রি আলিফ। দুই মাস আগে চারতলা ভবনে রং করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। শুক্রবার সকালে তার বৃদ্ধ মা আমেনা বেগম (৬৫)ছেলের মুখে মাল্টা তুলে দিচ্ছিলেন। বৃদ্ধা জানালেন, এ পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। ৮৫০টাকা দামের মেরোপেনাম ইনজেকশন দিতে হচ্ছে। ধারকর্জ করে ছেলেকে সারিয়ে তুলতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। ছেলের সঙ্গে হাসপাতালেই ঈদ করবেন তিনি।
তিনি জানান, আলিফের চার বছরের একটি ছেলে ও এক বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। ছেলেমেয়েরা বাবাকে দেখতে চায়। কিন্তু সারাশরীরে দগদগে ক্ষতচিহ্ন দেখে ভয় পায় বলে হাসপাতালে আনেননা।
তারাবো বিশ্বরোড সংলগ্ন মাদ্রাসার বাবুর্চি আনিসুর রহমান। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন তিনি। চারমাস যাবত তার বৃদ্ধ বাবা শামসুল ও বৃদ্ধা মা ওহিদা বেগম ছায়ার মতো সন্তানের পাশে হাসপাতালে থাকছেন। রাতে মাটিতে ঘুমাচ্ছেন।
শামসুল হক জানালেন, গত বছর আনিস তার স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে কুমিল্লার মুরাদনগরের গ্রামের বাড়িতে ঈদ করেছিলেন। কিন্তু এবার তার দুর্ঘটনা ঈদের আনন্দ মাটি করে দিয়ে গেছে। কিভাবে চিকিৎসা খরচ চালাবেন এ চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারেননা বলে জানান বৃদ্ধ।
২০ বছরের তরুন ইসমাইল। গার্মেন্টসে ডাইং সেকশনে কাজ করতেন। একমাস আগে গার্মেন্টেসে কাজ করার সময় মেশিন বিভ্রাটের কারণে গরম পানিতে শরীর পুড়ে যায়। মা পিয়ারা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, খুব শখ ছিল সোনারগাঁও গ্রামের বাড়িতে ছেলেকে সহ ঈদ করবেন কিন্তু সে আশা পূরণ হচ্ছেনা। হাসপাতালেই ঈদ করতে হবে তাদেরকে।
রবিউল ইসলাম নামে এক যুবক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে গত পাঁচ বছর যাবৎ বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকদফা অপারেশন করলেও সুস্থ হননি।
তিনি জানান, টাকার অভাবে চিকিৎসা থেমে থেমে করতে হচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেও চাঁদপুরে স্ত্রী, ছেলে মেয়ের সঙ্গে ঈদ করতে যেতে পারেননি। টাকার অভাবে কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেননি। একাই হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
রবিউল বলেন, হাজার হাজার মানুষ স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাচ্ছে দেখে মনটা খুব খারাপ হয়েছে।
এমইউ/এসকেডি/পিআর