প্রতিদিন ২০০ টন হাসপাতাল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সাধারণ ডাস্টবিনে
রাজধানীতে প্রতিদিন ২০০ টন হাসপাতাল বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যের ডাস্টবিনে ফেলা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ ধরণের বর্জ্য ইনসিনেরেটর মেশিনে পুড়িয়ে ফেলার নিয়ম থাকলেও তা পালিত হচ্ছে না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সুই, সিরিঞ্জ, স্যালাইন প্যাকেট, ক্যানুলা সেট, তরল ওষুধের শিশি, বোতলের ছিপি, রক্ত, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা, শল্যবিদদের ব্যবহৃত ছোট ছুরি, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বিছিন্নকৃত বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের টুকরা ও ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কেমিকেল রি-এজেন্ট সাধারণ বর্জ্যের সাথে ডাস্টবিনেই ফেলা হচ্ছে। ফলে পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বাইরের ডাস্টবিন থেকে এক শ্রেণির দরিদ্র শিশু কিশোর প্রতিদিন কোন প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়ে খালি হাতে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য কুঁড়াচ্ছে।
এভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য কুঁড়ানোর ফলে শিশু কিশোররা হেপাটাইটিস বি, সি এমনকি এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
জানা গেছে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পাঁচ বছর মেয়াদি (২০১১-২০১৬) কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এ কর্মপরিকল্পনার আওতায় ৬৪ জেলা হাসপাতালে মেডিকেল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড ডিসপোজাল ইউনিট স্থাপন, প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি ও হাসপাতাল বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পরিবহন কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিযোগ বাস্তবে অধিদফতরের কর্মকাণ্ড তাদের চোখে পড়ে না।
এক যুগেরও বেশি সময়ের পুরনো এক গবেষণা জরিপ অনুসারে রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ২০০ টন হাসপাতাল বর্জ্য। তরল ও কঠিন দুই ধরণের হাসপাতাল বর্জ্যের (বায়োলজিক্যাল, কেমিক্যাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, রেডিও অ্যাকটিভ, সুই, সিরিঞ্জ, ব্লেড, ভাঙ্গা গ্লাস ইত্যাদি) মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
দেশে বিদ্যমান হাসপাতাল বর্জ্য (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্রসেসিং) রুলস ২০০৮ অনুসারে যে কোন নতুন হাসপাতাল স্থাপনের অনুমতি পাওয়ার পূর্বশর্ত পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলকভাবে পেতে হবে। অন্যথায় কোনভাবে হাসপাতাল স্থাপনের অনুমতি পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই হাসপাতাল স্থাপনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে হাসপাতালগুলোতে বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ইনসিনেরেটর মেশিন স্থাপন করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালে সে সুবিধা নেই।
জানা গেছে, হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মচারী ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য বিক্রির ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। তারা নিজেরাই বিভিন্ন বর্জ্য গোপনে বেশি দামে বাইরে বিক্রি করে দেয়।
অবশিষ্ট ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ডাস্টবিনে ফেলা হয়। সেখান থেকে পথশিশুরা তা কুড়িয়ে এক শ্রেণির বর্জ্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। বর্জ্য ব্যবসায়ীরা কেজি দরে কিনে নিয়ে অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে।
এভাবে বিভিন্ন হাত বদল হয়ে চূড়ান্তভাবে সেগুলো রি-সাইক্লিং এর মাধ্যমে রি-প্যাকিং হয়ে বাজারে বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, কোন প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া ক্লিনিক্যাল বর্জ্য কুড়ানোর ফলে হেপাটাইটিস বি, সি ও এইডস রোগে আক্রান্ত হওয়ার মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সম্প্রতি এ প্রতিবেদক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন, মধ্য দুপুরে হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকের উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ডাস্টবিন থেকে হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল বর্জ্য খুঁজছে পনের ষোল বছরের এক কিশোর।
মাথার ওপর প্রচণ্ড সূর্যের তাপ থাকায় দরদর করে ঘামছিল সে। তবুও ক্লান্তিহীনভাবে দ্রুত হাত চালিয়ে হাসপাতাল বর্জ্যের ড্রাম থেকে স্যালাইন ব্যাগ, ইনফিউশন সেট, ওষুধের বোতল, সুই ও সিরিঞ্জসহ বিভিন্ন সামগ্রী কুঁড়াচ্ছিল।
এ প্রতিবেদক এসব বর্জ্য খালি হাতে কেন কুঁড়াচ্ছে, কোথায় কত টাকায় বিক্রি করে, থাকে কোথায় ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলে ভীষণ বিরক্ত হয়ে উত্তর না দিয়ে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
কয়েক দফা জিজ্ঞেস করার পর সে জানায়, পেটের তাগিদে সে প্রতিদিন ১৫০ টাকা বেতনে চাকরি করে। সিটি করপোরেশনের এক কর্মচারী তার মালিক। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালের বর্জ্য ডাস্টবিনে ফেলার পরপরই তা থেকে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য কুড়িয়ে সংগ্রহ করে।
পরে তার মালিক সেগুলো নিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে। সে জানায়, মাঝে মাঝে হাতে গ্লাভস পড়ে। সুইয়ের ফোঁড় খেয়ে প্রায়ই তা ছিঁড়ে যায়। তাই মাঝে মাঝে গ্লাভস ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হয় সে। কাজ শেষে রাতে এই ফুটপাতেই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
এ কিশোরের মতো রাজধানী জুড়েই অসংখ্য হতদরিদ্র কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ক্লিনিক্যাল ও নন-ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করছে।
বর্তমানে বেশ কিছু সংখ্যক সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করছে প্রিজম নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তারা হাসপাতাল থেকে বিভিন্ন রংয়ের (লাল, কালো ও হলুদ) ড্রাম থেকে বিভিন্ন ধরণের বর্জ্য নিয়ে মাতুয়াইল ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে ফেলে ও প্রয়োজন হলে ইনসিনেরেটর মেশিনে পুড়িয়ে ফেলে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় চার বছর আগে ২০১১ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক মো. মাহমুদুর রহমান এক পরিপত্রে হাসপাতাল বর্জ্য সঠিকভাবে অপসারণ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন।
সাধারণ বর্জ্যের সাথে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য ফেলার কারণে শিশু শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি ও পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তিনি এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নেরও সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়নি।
এমইউ/এআরএস/এসএইচএস/আরআইপি