রূপ হারিয়েছে রুপসী বাংলা!
রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা ব্যবসায়ী সোলেমান হোসেন। সম্প্রতি এক বিকেলে তিনি স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদের নিয়ে সিএনজি ট্যাক্সিতে চেপে মোহাম্মদপুরে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে রওনা হন।
শাহবাগের সিগন্যাল পার হয়ে কিছুদূর এগিয়ে যানজটে পড়ে প্রায় এক ঘণ্টা বসে আছেন। বেড়ানোর হাসিখুশী মুড নিয়ে বাসা থেকে বের হলেও যানজটে ঘেমে ভিজে মেজাজ খিটখেটে তার।
হঠাৎ তার আট বছরের ছেলে একটি বহুতল ভবনের দিকে আঙ্গুল তুলে বললো, এইডা দেহি আমাগো লালবাগের কিল্লার লাহান লাগে ? মাগার বিল্ডিংডা এমুন ভাঙ্গাচোরা কেলা?
ছেলের প্রশ্ন শুনে ভবনটির দিকে তাকিয়ে সোলেমান হোসেনের মুখ থেকে আহ্ শব্দটি বেরিয়ে এলো। উনি ছেলেকে বললেন, নারে বাপ, এইডা তো ফাইভ ইষ্টার রুপসী বাংলা হোডেল, এত ছুনদর হোডেলডা কেলা(কেন)যে এমুন ভাঙ্গাচোরা বুজবার পারলাম না?
শুনতে নাটক বা গল্পের স্ক্রিপ্টের মতো শুনালেও শাহবাগ মোড় থেকে বাংলামোটর কিংবা বেইলী রোডের দিকে যাতায়াতকারি হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিনই এক সময়ের রুপসী বাংলা হোটেল ভবনটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলেন। তাদের সকলের মনে একই প্রশ্ন রুপসী বাংলা হোটেলটির কেন এমন ভাঙ্গাচোরা বেহাল দশা। তারা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে কত ধরনেরই না আলাপ আলোচনা করেন।
এক সময় পাঁচ তারকা হোটেলটির ভেতরে বাইরের সুন্দর সাজসজ্জা দেখে চোখ জুড়িয়ে যেতো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অতিথিরা শত শত ডলার খরচ করে এ হোটেলে থাকতেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের নামিদামি অতিথিরা সভা, সেমিনার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ছুটে আসতেন।
শত শত মানুষের পদচারণায় হোটেলটি দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই মুখরিত থাকতো। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই সুন্দর আলোকসজ্জায় চারদিকে দ্যুতি ছড়তো। কিন্তু এখন সন্ধ্যা নামতেই নেমে আসে অন্ধকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১ জুন থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত পাঁচ তারকা হোটেল রুপসী বাংলা সংস্কারের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৬ সালে এ হোটেলটি যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম বন্ধ হলো।
১৯৭১সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এটি বন্ধ হয়নি, চালু ছিল। সংস্কার শেষে আগামী বছরের শুরু থেকে এ হোটেলটি নতুন ‘ইন্টার কন্টিনেন্টাল ঢাকা’ নামে ফের চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ৪৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে সংস্কার কাজ চলছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা বাংলাদেশ সার্ভিস লিমিটেড (বিএসএল) ও ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপের মধ্যে নতুন করে হোটেলটি চালুর জন্য ৩০ বছরের চুক্তি হয়েছে।
সূত্র জানায়, রুপসী বাংলা হোটেলে ছোট বড় মিলিয়ে ২৭২টি কক্ষ ছিল। সংস্কারের পর কক্ষের সংখ্যা ২৩১টি করা হবে। আয়তনের দিক থেকে কক্ষের আকার ২৬ থেকে ৪০ স্কয়ার মিটার করা হবে।
বিশ্বমানের অতিথি সেবা নিশ্চিত করতে পুরোনো পাইপ, তার ও ফিটিংসসহ প্রয়োজনীয় সব সংস্কার করা হবে। সেই সাথে সুইমিং পুল ও ডাইনিং হলের স্থান পরিবর্তন করা হবে।
জানা গেছে, রুপসী বাংলা হোটেলের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে রুপসী বাংলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও বলাকা লাউঞ্জে পুর্নবাসিত করা হয়েছে। সংস্কার কাজ শেষে তারা আবার নতুন নামের হোটেলে যোগদান করবেন।
নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, রুপসী বাংলা হোটেলটি লাভজনকভাবে পরিচালিত হয়ে আসছিল। ২০১১ সালে ৪০ কোটি, ২০১২ সালে ৪৭ কোটি ও ২০১৩ সালে ১৯ কোটি টাকা মুনাফা করে। হোটেলটি অনেক পুরোনো হওয়ায় ক্রমেই হোটেলে অতিথির সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন করে চুক্তি ও সংস্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এ হোটেলের নাম ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। পরবর্তীতে শেরাটন কর্তৃপক্ষ ২৫ বছরের চুক্তিতে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত থেকে ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হোটেল শেরাটন নামে এটি পরিচালনা করে। পুন:চুক্তি না হওয়ায় নতুন করে হোটেল রুপসী বাংলা নামকরন করা হয়। সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত রুপসী বাংলা নামেই পাঁচ তারকা হোটেলটি চালু ছিল।
এমইউ/এআরএস/আরআইপি