বৈষম্যে ২৬ ক্যাডারে ফের দানা বাঁধছে ক্ষোভ
পদোন্নতির সীমিত সুযোগ থাকায় ২৬টি বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তারা সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেলের মাধ্যমে কিছুটা লাভবান হতেন। ২০১৫ সালের বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বাদ দেয়ায় প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে।
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নামেন প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক (প্রকৃচি) এবং ২৬টি ক্যাডার ও বিভিন্ন ফাংশনাল সার্ভিসের কর্মকর্তারা। আন্দোলনের মুখে বৈষম্য দূর করার আশ্বাস দেয় সরকার। কিন্তু প্রায় দুই বছর হয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে ফের ক্ষোভের দানা বাঁধছে ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সভায় বসেছিল বিসিএস সমন্বয় কমিটি। অষ্টম জাতীয় বেতনস্কেলের মাধ্যমে সৃষ্ট বৈষম্য নিরসনে সকল ক্যাডার ও অধিদফতরের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পথ খুলে দেয়ার কাজে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় কমিটি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ বিষয়ে ফের আন্দোলনে যাওয়ারও চিন্তা-ভাবনা করছেন তারা। ২৬টি ক্যাডারের মোট কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার।
বিসিএস সমন্বয় কমিটির নেতারা জানান, ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চার সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর আন্দোলন থেকে সরে আসে প্রকৃতি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। ওই সভায় প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ ও শিক্ষা সচিব মো. সোহরাব হোসাইন অংশ নেন।
বৈঠকে ওয়ানস্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সকল ক্যাডার ও অধিদফতরের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের যথাসময়ে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে ক্যাডার ও অধিদফতরের পদোন্নতির সোপান সুষমকরণ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
বিসিএস সমন্বয় কমিটির মহাসচিব মো. ফিরোজ খান গত সোমবার জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৪ মাসে পদোন্নতির সোপান সুষমকরণের (সবার জন্য সমান পদোন্নতির সুযোগ) কাজ শেষ করা হবে বলে সরকারের দায়িত্বশীল চারজন সচিব প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সঙ্গে বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিভিন্ন অজুহাতে কাজটি সম্পন্ন করতে বিলম্ব করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে সচিব কমিটির সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে দ্রুত কাজ করার তাগিদ দেয়া হয়। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে, প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কালক্ষেপণ করছে। ফলে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।’
মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের দাবি-দাওয়া সম্বলিত স্মারকলিপি প্রস্তুত করেছি, এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাব। এরপর সব ক্যাডার নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বসে আমাদের কোন কোন দাবি-দাওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, এর রূপরেখা তৈরি করব। প্রশাসন যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের দেয়া কমিটমেন্টগুলো কোথায় ব্রেক হয়েছে সেগুলো নিয়েও আলোচনা করব।’
আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব উম্মুল হাসনা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ক্যাডারের পদ সৃজনের মাধ্যমে পদোন্নতির সমস্যা সমাধানে কিছু কাজ করছি। ক্যাডারভিত্তিক যে প্রস্তাব যখন আসছে, সে বিষয়ে আমরা মিটিং করছি। শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্যাডারদের সঙ্গে মিটিং করছি। সেই কাজগুলো হচ্ছে।’
বিসিএস সমন্বয় পরিষদের মহাসচিব বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সরকারি কর্মচারীর মধ্যে একটি ইউনিফরমিটি (একই ধরনের সুবিধা) বজায় রাখতে ১৯৭৫ সালে সার্ভিস (রিঅর্গানাইজেশন অ্যান্ড কন্ডিশনস) অ্যাক্ট জাতীয় সংসদে পাস করেন। কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে বিশেষত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে উপ-সচিবগণের জন্য সার্বক্ষণিক সরকারি গাড়ির আদেশ জারি এর আরেকটি উদাহরণ।’
তথ্য ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে আমরা চার ও ১২ বছরের সিলেকশন গ্রেড পেতাম এবং ১৮ বছরের টাইমস্কেল পেতাম। তখন পদোন্নতি না হলেও আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে এর অনেকটাই পূরণ হতো। কিন্তু নতুন বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল নেই। তাহলে তো আমার সবই গেল। এটা নিয়েই আমরা তখন আন্দোলনে নেমেছিলাম। সরকারও বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু এখনও কিছুই হল না।’
বিভিন্ন ক্যাডারের পদোন্নতির সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য অধিদফতর ও সংস্থাগুলোতে নতুন পদ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
আগের বেতন কাঠামো অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদোন্নতির নির্ধারিত সময়ে আর্থিক সুবিধা হিসেবে সিলেকশন গ্রেড পেতেন। আবার চাকরির একটি নির্ধারিত সময় অনুযায়ী টাইম স্কেলের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা দেয়া হতো।
বিসিএস সমস্বয় পরিষদের প্রচার সম্পাদক স ম গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘উপ-সচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদে সুপারনিউমারারি (অস্থায়ী) পদ সৃষ্টি করে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিশেষ সুবিধা নিচ্ছেন। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সমন্বয় কমিটির সভায় সকল ক্যাডারের জন্য সুপারনিউমারারি পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই নির্দেশনাও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। অপরদিকে উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দিয়ে বিভিন্ন অধিদফতরে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এতে ওই সব অধিদফতরের নিচের ধাপের কর্মকর্তারা পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করার পরও পদোন্নতি পাচ্ছেন না।’
অনতিবিলম্বে সকল ক্যাডার ও অধিদফতরের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের যথাসময়ে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে পদোন্নতির সোপান সুষমকরণের কাজ শেষ করা, পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাচের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে সকল ক্যাডারের সুপারনিউমারারি পদোন্নতি নিশ্চিত করা এবং প্রেষণ প্রথা বাতিলেরও জোর দাবি জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, সরকার ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর অষ্টম বেতন কাঠামোর গেজেট জারি করে। তবে নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর ধরা হয় ওই বছরের ১ জুলাই থেকে।
এরপরই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা কালো ব্যাজ ধারণ করেন। এর মধ্যে ২৩ ডিসেম্বর সারাদেশে মানববন্ধন ও ২৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। ২৭ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন এক ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করে সমন্বয় কমিটি। পরে দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করা হয়।
পরে অষ্টম বেতন কাঠামোতে পদমর্যাদা ও বেতনক্রম অবনমনের অভিযোগ তুলে বৈষম্য নিরসনের দাবিতে ২০১৬ সলের ২৬ থেকে ২৮ জানুয়ারি কর্মবিরতি পালন করেন দেশের সরকারি কলেজের শিক্ষকরা।
আরএমএম/এমএআর/আরআইপি