ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

‘রোহিঙ্গা স্বীকৃতি পেলে ফিরব, নয় বাংলাদেশে মরব’

আদনান রহমান | উখিয়া (কক্সবাজার) থেকে | প্রকাশিত: ০৬:০৩ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

‘মিয়ানমার আমাদের বাঙালি হিসেবে নির্মম নির্যাতন করেছে। আমাদের চোখের সামনে ঘরের পুরুষদের তিন টুকরা করেছে। আমরা বাঙালি না, আমরা রোহিঙ্গা। মিয়ানমার যদি আমাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তবেই কেবল দেশে ফিরে যাব। না হলে কষ্ট করে এই দেশেই থেকে যাব। বাংলাদেশেই মরব।’

চোখে-মুখে তীব্র বিরক্তি আর ক্ষোভ নিয়ে একথা বলছিলেন নূরজাহান নামে এক রোহিঙ্গা নারী। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা লাখো রোহিঙ্গার মধ্যে তিনিও একজন। বর্তমানে থাকছেন কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।

রোববার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে আশ্রয়কেন্দ্র সিগ্যাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জাগো নিউজের কথা হয় অসংখ্য বয়স্ক নারী ও পুরুষ রোহিঙ্গার সঙ্গে। এ সময় এগিয়ে এসে এ ক্ষোভ উগড়ে দেন নূরজাহান।

‘বাংলাদেশে এসেছেন। রাতে থাকায় কষ্ট হচ্ছে। একবেলা খাবার জুটছে, আরেকবেলা জুটছে না। কষ্ট করে থাকছেন। যদি মিয়ানমারে ফেরার সুযোগ হয়, ফিরবেন?’

Rohinga-Camp

এদিন কুতুপালং ও বালুখালী রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে এ প্রশ্ন করা হয় রোহিঙ্গাদের অনেককেই। প্রশ্ন শুনে কেউ উত্তর দিয়েছেন, কেউ কেউ হেসেছেন। তবে অনেকে বলেছেন, ‘ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’

একই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন ৮৫ বছরের এক বৃদ্ধা। একই প্রশ্ন করা হয় তাকেও। উত্তরে লাঠি ভর করে চলা এই বৃদ্ধা জানান, তার নাম হালিমা খাতুন। ঈদের পরদিন (৩ সেপ্টেম্বর) থেকে তারা বাংলাদেশে।

একই প্রশ্ন ফের করা হলো তাকে- ‘ফিরে যেতে চান কিনা?’ আঞ্চলিক ভাষায় তিনি যে উত্তর দিলেন, তার অর্থ দাঁড়ায়- ‘সেখানে যে অবস্থা দেখেছি; কিছু না ভেবে একসঙ্গে ১২ জন নারী আমরা বাংলাদেশে এসেছি। একেক সময় একেক জন আমাকে কাঁধে বহন করেছে। আমাদের ঘরবাড়ি সব পুড়িয়ে দিয়েছে। কিছুই নাই। যদি মিয়ানমারে শান্তি ফেরে, তাহলে আবার মাতৃভূমিতে ফিরে যাব। ঘরবাড়ির দরকার নাই, আমাদের জমিটুকু বুঝিয়ে দিলেই নিজের মতো করে থাকার ব্যবস্থা করে নেব।’

Rohinga-Camp-3

রাখাইনের বুচিদং থেকে ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসেছেন আমেনা খাতুন। কুতুপালং ক্যাম্পের ওমেন্স মেডিকেল সেন্টারের পাশের সড়কে অসহায়ের মতো বসেছিলেন তিনি। কোলে দেড় বছরের ছেলে রহিমুল্লাহ। রহিমুল্লাহর কানে ঘাঁ হয়েছে। চিকিৎসক দেখিয়েছেন। পাশেই আমেনার মেয়েটি ছোট ভাইয়ের ওষুধ হাতে বসে আছে। আমেনার সামনে যেতেই ভাবলেন, হয়তো ত্রাণ দিতে বা ত্রাণের তালিকা প্রস্তুতের কাজে গিয়েছি। তার সামনে যেতেই বললেন, ‘খুব কষ্টে আছি। ক্যাম্পের ভেতরে কেউ খাবার নিয়ে যায় না। তাই রাস্তায় বসে আছি। এভাবে আর কতদিন?’

আমেনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জানতে চাওয়া হলো, ‘এখানে এত কষ্ট, সুযোগ হলে দেশে ফিরবেন কি?’ উত্তরে বললেন, ‘ইতারা শান্তিমতো থাইকতে দিলে আরা যাইয়ুম জন্মভূমিত। তারা শান্তিতে থাকতে দিলে আমরা জন্মভূমিতে ফিরে যাব।’

রাখাইনের আটিপাড়া থেকে ৯ সেপ্টেম্বর স্ত্রী আর ৫ সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন নজীর আহমেদ। একই প্রশ্ন করা হলো তাকেও। উত্তরে জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতের আঁধারে তাদের ঘরে আগুন দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তারা কোনোমতে বের হতে পারলেও এক ছেলে ও এক মেয়ে ঘুমের মধ্যেই পুড়ে মারা যায়। তাদের মরদেহ সেখানে রেখেই রওনা হন বাংলাদেশের দিকে। এখানে এখন তাদের অবস্থা আরও খারাপ। যদি সেদেশে শান্তি ফেরে, তবে সেখানেই ফিরে যাবেন।

জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয়েছে আরও অন্তত ১৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক রোহিঙ্গার। তবে এদের কেউই এখন মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয়। তাদের অনেকে ‘ভবিষ্যতে’ পরিস্থিতি দেখে যাওয়ার বিষয়ে ভাববেন বলে জানান।

Rohinga-Camp

রাখাইনে দমন-পীড়নসহ নানা সমস্যার কারণে ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গারা। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে তারা এসেছে। তবে অনেককে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তাদের সরকার। এরপর প্রায় সাড়ে ৩ দশকে নানা সময়ে আরও প্রায় ৫ লাখের মতো রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।

সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মুখে পালিয়ে এখন পর্যন্ত নতুন করে আরও ৪ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে।

আগে আসা অনেককে ফিরিয়ে নিলেও বর্তমানে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে মিয়ানমার। ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ দাবি করে ফিরিতে নিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে রাখাইন থেকে তাদের উচ্ছেদ অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার।

Rohinga-Camp

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা যদি ফিরে যেতে না চান, বা তাদের ফিরিয়ে না নেয়া হয়; তাহলে ভুগতে হতে পারে কক্সবাজারবাসীকে। ইতোমধ্যেই কক্সবাজারের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও চায়ের দোকানে এসব নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা।

উখিয়ার একাধিক বাসিন্দা জানান, কক্সবাজারের প্রতিটি ব্যবসায় এখন আধিপত্য বিস্তার করেছে আগে থেকেই বসবাস করা রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ‘লালন-পালন’ কতটুকু সুখকর হবে বাংলাদেশের জন্য, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।

এআর/এসআর/পিআর