এবার বোধহয় ওকে আমি বাঁচাতে পারব না
১৫ মাস বয়সী রুশনারা। গত কয়েকদিন ধরে সর্দিতে ভুগছে। নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। এর থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে সে ডায়রিয়াতে আক্রান্ত। একদিন রাস্তার পাশে থাকা খোলা আইসক্রিম খেয়েছিল, ধানক্ষেতে জমে থাকা পানিও পান করেছিল; যেখানে লোকে মলমূত্র ত্যাগ করে। মা রাশিদা তার এই দুর্ভোগ নিয়ে খুবই চিন্তিত।
‘ও আমার সবচেয়ে আদরের সন্তান। আমার আরও ছয় সন্তান আছে। ভয় হচ্ছে, এবার বোধহয় ওকে আমি বাঁচাতে পারব না’- বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন উদ্বিগ্ন মা রাশিদা বেগম।
বুধবার সরেজমিন কুতুপালং ও বালুখালি রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে গিয়ে শরণার্থী রোহিঙ্গা মা ও শিশুদের দুর্দশার বিভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।
রাশিদা বলেন, বন্দুকের মুখ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছি ঠিকই, কিন্তু সেই জীবন এখন টিকিয়ে রাখাই দায়। কষ্টের একেকটি মুহূর্তের সঙ্গে যোগ হয়েছে টানা বৃষ্টি। বাচ্চাদের তো আর বদ্ধ ঘরে আটকে রাখা যায় না। বৃষ্টি হলেই ছুট দেয় খোলা জায়গায়। কাদাপানিতে মাখামাখি করে ঠান্ডা বাধিয়েছে। জ্বরও আছে। কী হয় বুঝতে পারছি না।
কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড়ের ওপর নির্মিত ক্যাম্পের সর্বত্র কর্দমাক্ত হয়ে পড়েছে। ঠিক মতো চলাই যেন দায়। কিছু রোহিঙ্গা শিশুকে কাদামাটিতে খেলাধুলা করতে দেখা যায়। অনেকে বাধ্য হয়ে মূল রাস্তায় এসে সড়কের দু’ধারে অবস্থান নিয়েছেন ত্রাণের আশায়।
রাশিদা বেগম আরও জানান, পাঁচদিন হলো এ ক্যাম্পে অবস্থান করছি। কোনোরকম পলিথিনের ছাউনি দিয়ে স্বামী-ছয় সন্তানের মাথাগোঁজার ঠাঁই হয়েছে। ভারি কোনো খাবার তেমন পেটে পড়েনি। চিড়া-বিস্কুট খেয়েই অধিকাংশ সময় পার করতে হয়। নেই বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা। বাধ্য হয়ে বাচ্চারা পাশের জলাশয়ের পানি পান করে। এ কারণে শিশুদের নানা ধরনের রোগব্যাধি লেগেই আছে।
১৯৯১ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ আইয়ুব। তিনি এখন কুতুপালং ক্যাম্পটির তত্ত্বাবধায়ক। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, এখানে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোর জরুরি ভিত্তিতে বিশুদ্ধ খাবার পানি, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ও খাবার স্যালাইন প্রয়োজন। বৃষ্টিবাদলের এদিনে শক্ত-মজবুত ঘর তৈরির জন্য বাঁশ, সামিয়ানাও প্রয়োজন। বিশুদ্ধ খাবার পানি নিশ্চিত করতে টিউবওয়েল বসানো দরকার।
তিনি জানান, দিনের পর দিন আশ্রিতরা হালকা খাবার খাচ্ছে। এখন তাদের জন্য ভারি খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য চাল, ডাল ও তেল সরবরাহ করা প্রয়োজন। এসব জিনিস নিশ্চিত করতে পারলে আশ্রিত মানুষগুলো একটু স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতে পারবে। শিশুদের পানিবাহিত রোগবালাইও রোধ করা সম্ভব হবে।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে চার লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা এসব শিশু অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। অপুষ্টিতে ভুগছে অধিকাংশ শিশু। তাদের বাঁচিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম থেকে জানা যায়, এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা হাসপাতালে সবমিলিয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ১৩ হাজার রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। আগে ধারাল অস্ত্র বা গুলিতে আহত রোগীর সংখ্যা বেশি থাকলেও এখন পানিবাহিত ও অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেশি।
এছাড়া শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেশ। শ্বাসতন্ত্রে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে একজনের। চর্মরোগে আক্রান্ত দেড় হাজারের অধিক রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের এমআর টিকা (হাম-রুবেলা প্রতিরোধক), ভিটামিন-এ ক্যাপসুল ও পোলিও টিকা খাওয়ানো কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। ১৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বৃহৎ আঙ্গিকে তিনটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের রোগপ্রতিরোধক টিকা ও ক্যাপসুল সেবন করানো হচ্ছে।
কক্সবাজারের ক্যাম্প, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল মিলে এখন পর্যন্ত মোট ২০ হাজার শিশুকে টিকা দেয়া ও ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়েছে। বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন সংস্থা টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।
বুধবার সরেজমিন কুতুপালং ও বালুখালি রেজিস্টার্ড ক্যাম্প ঘুরে শিশুদের লাইন ধরে টিকা ও ক্যাপসুল খাওয়াতে দেখা গেছে। সেখানে লাইন ধরে চিকিৎসাসেবা নিতে দেখা গেছে গর্ভবতী নারীদেরও। উভয় ক্যাম্পের পৃথক মেডিকেল সেন্টারে পুরুষরা ফাস্টএইড ও নানা রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছেন।
কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সালাম বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভুগছে৷ টানা বৃষ্টি ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে সর্দি, কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, পাতলা পায়খানাসহ ক্যাম্পগুলোতে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণে বিভিন্ন চর্মরোগের আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
‘জরুরি ভিত্তিতে শিশুদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া স্যালাইন ও প্যারাসিটামল সিরাপসহ তাদের পুষ্টিকর খাবারের প্রতি জোর দিতে হবে। মাঠপর্যায়ে আমাদের ৩৬টা টিম কাজ করছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। আশা করছি, সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি ভালো অবস্থানে যেতে পারব আমরা’- যোগ করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)-এর হিসাব অনুযায়ী, নতুন আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় তিন লাখের জরুরি ভিত্তিতে পুষ্টি সহায়তা প্রয়োজন৷ আর যাদের এই পুষ্টি সহায়তা প্রয়োজন তাদের মধ্যে এক লাখ ৫৫ হাজার আছে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশু৷ ১৪ হাজার শিশু চরম পুষ্টিহীনতায় ভুগছে৷
এছাড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে বাবা-মা হারা প্রায় এক হাজার ৩শ রোহিঙ্গা শিশু। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এ তথ্য জানিয়েছে।
এআর/এমএআর/বিএ