চাল নিয়ে মন্ত্রী-ব্যবসায়ীদের বৈঠকে হট্টগোল
চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। চালের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মঙ্গলবার সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বৈঠকে চালকল মালিক, ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা সরকারের নানা উদ্যোগের ‘অসঙ্গতি’ তুলে ধরে বক্তব্য দেন।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে দফায় দফায় হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। তবে বৈঠকে ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়া পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এতে চালের দাম কমে যাবে বলে জানিয়েছেন চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
বৈঠকের শুরুতে খাদ্যমন্ত্রী জানান, দেশে এক কোটি টন চাল মজুদ আছে। সরকারের হাতে বিভিন্ন কর্মসূচির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে মজুদ করে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন। তা না হলে এভাবে চালের মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ নেই।
জয়পুরহাট চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল বারী বলেন, ‘চাল আমদানির ট্যারিফ কমানো নিয়ে আপনাদের (সরকারের) সিদ্ধান্ত রঙ (ভুল) ছিল। আমাদের দেশে চালের সংকট আর আমরা ধীরে ধীরে চালের ট্যারিফ কমাচ্ছি। আর পর্যায়ে পর্যায়ে ভারতে দাম বাড়ছে। তাহলে ট্যারিফ কমিয়ে লাভ হলো কী?’
তিনি বলেন, ‘কৃষিমন্ত্রী যদি বলেন আমি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেব। বাণিজ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বলেন আমরা ট্যাক্স কালেকশন করব। খাদ্যমন্ত্রী যদি বলেন আমি দাম কমাব। পাট প্রতিমন্ত্রী যদি বলেন আমি পরিবেশ রক্ষা করব। তাহলে কি স্যার আপনার প্রকিউরমেন্ট হবে। বলেন স্যার, বলেন?’
‘সারাবিশ্বের মধ্যে কোন দেশে পাটের বস্তায় কেনা-বেচা হয় দেখান স্যার। ট্যারিফ কমানো যুক্তিযুক্ত হয়নি। সময় মতো একেবারে সব তুলে দিতেন।’
আমিনুল বারী বলেন, ‘অটোমেটিক রাইস মিলে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৪২ টাকা। আপনি স্যার (বোরো সংগ্রহে) মূল্য দিলেন ৩৪ টাকা। হাউ ক্যান ইট পসিবল। মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করলেও আমরা চুক্তি করে ফেলতাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্যমন্ত্রী যখন ভিয়েতনাম থেকে ২০ হাজার টন সিদ্ধ চাল আমদানি করলেন ৪৭৫ ডলার করে। সেই সময় যদি আমাদের বলা হত তোমাদের ৪৫০ ডলার দাম দেব তোমরা যেখান থেকে পার চাল এনে দাও, আমরা দিতে পারতাম। আমাদের সুযোগ দিচ্ছেন না।’
‘আমাদের প্রকিউরমেন্ট হচ্ছে না, আপনার তো ব্যবস্থা নিতে হবে। সময় মতো ব্যবস্থা নিতে হবে’ -বলেন আমিনুল।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো ইন্ডিয়া থেকে চেষ্টা করেও চাল আনতে পারিনি।’
জয়পুরহাট চালকল মালিক সমিতির এই নেতা আরও বলেন, ‘আপনি তো পারবেন না স্যার। হ্যাজার্ড আছে। আপনি যখন ৪৭৫ ডলারে চাল আনছেন ইন্ডিয়াতে তখন ৩৮০ ডলার দাম ছিল।’
এ পর্যায়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তার কথার সঙ্গে একমত, বাস্তব কথা বলেছেন।’
চালকল নেতা বারী বলেন, ‘খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন আমরা কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছি। কী ধরনের সঙ্কট আমরা করেছি। আমাদের এক্সপ্লেইন করেন।’
এ পর্যায়ে চরম হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। অনেকেই দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন।
পর্যায়ক্রমে চাল আমদানির শুল্ক কমানোর সমালোচনা করেন আরও কয়েকজন আমদানিকারক ও মিল মালিক।
একজন মিল মালিক বলেন, ‘পাটের বস্তার কারণে কেজিপ্রতি চালের দাম এক টাকা বেড়ে যায়। দাম কমাতে জোগান বাড়াতে হবে। চাল জাহাজে আনতে হবে, রাস্তা দিয়ে আনতে হবে। রেলে আনতে হবে। রোহানপুর বন্দর দিয়ে ট্রেনে চাল আনা যায় না।’
বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাসকিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল রশীদ বলেন, ‘এই মিটিংটি আগেই হওয়া প্রয়োজন ছিল। যেহেতু সমস্যা হয়েছে সরকারি গুদামে চাল দিতে আমরা দামটা একটু বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম। (দাম না বাড়ানোর পরও) আমরা লস দিয়ে হলেও চুক্তির বেশির ভাগ চাল সরবরাহ করেছি।’
একজন মিল মালিক বলেন, ‘কৃষকদের কাছে এখনও ধান আছে। ধানের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চালের দাম বেড়েছে।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষকদের হাতে কোনো ধান নেই।’
তখন অনেকেই সমস্বরে বলে ওঠেন, ‘কৃষকদের কাছে ধান আছে। দাম বাড়ার কারণে ধান আছে স্যার।’
দিনাজপুরের জহুরা অটো মিলের মালিক আব্দুল হান্নান বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ হাজার টন চাল আমি সরকারকে দিয়েছি। সার্কিট হাউজে লুঙ্গি পরে ভাত খাওয়ার সময় মন্ত্রী আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম স্যার ট্যাক্সটা একটু হালকা তুলে নেন। আমাদের হাওরের ফসলে মার খেয়েছি। আমাদের মোটা চালের আবাদও কম। আপনি এত চাল সংগ্রহ করতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আপনাদের বুঝতে হবে এক কোটি টন ধান-চাল এই বাজারে আমাদের কাছে নেই। যদি থাকে তবে প্রমাণ দিন। আমরা প্রমাণ দেখতে চাই।’
এ সময় হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। অনেক ব্যবসায়ী বলেন, ভুল, ভুল, এক কোটি টন চাল নেই।
আব্দুল হান্নান আরও বলেন, ‘আমন ধান ওঠা পর্যন্ত আপনাদের পলিসি করে, বুদ্ধি করে চলতে হবে। কারণ আমন সিজনে (মৌসুমে) ৮০ ভাগ মোটা চাল হয়। ইরি সিজনে ২০ শতাংশ মোটা চাল হয়। আমাদের সমাধানে আসতে হবে। আমনে কী দাম থাকবে... ভালো ভালো ব্যবসায়ীদের নিয়ে আপনাকে বসতে হবে। আমনে আপনারা একটু নজর দেন।’
নবাব অটো রাইস মিলের মালিক আকবর শেঠ বলেন, ‘আপনারা আজকে মিটিং ডেকেছেন আমাদের মনের কথাগুলো শুনবেন। এতে দেশের উন্নয়ন হবে। যমুনা ব্রিজে তিনগুণ বেশি টোল নেয়া হয়। আসা-যাওয়ায় তিন হাজার টাকা টোল দিতে হয়। ফেরিতে যেখানে এক হাজার টাকা সেখানে নেয়া হয় চার হাজার টাকা। ট্রাক ভাড়া বেশি হলেও সেই টাকাটা চালের ওপর যায়।
মিল মালিকরা মোটা চাল কেটে মিনিকেট করে কৃষিমন্ত্রী এ তথ্য তুলে ধরতেই ফের হট্টগোল শুরু হয় বৈঠকে। একজন মিল মালিক বলেন, ‘এটা সত্য নয়। একজন সিনিয়র মন্ত্রী হয়ে আপনি কীভাবে এটা বলেন।’
একপর্যায়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম বক্তব্য দিতে দাঁড়ালে বৈঠকে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সভায় উপস্থিত বেশির ভাগ মিল মালিক দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, তার মিল কোথায়? উনি সরকারকে কতটুকু চাল দিয়েছেন? তার কোনো কথা আমরা শুনব না।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি সবাই মিলে এ সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে পারব। আপনারাও এদেশের নাগরিক আমরাও এদেশের নাগরিক। তাই কারও সঙ্গে সাপে-বেজিতে সম্পর্ক থাকা উচিত নয়।’
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মোটা চাল কেটে মিনিকেট বানানো হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। মিনিকেট ও স্বর্ণা ভারত বা অন্য দেশ থেকে এদেশে এসেছে। এর স্পষ্ট বৈশিষ্ট আছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বিজ্ঞানীদের দিয়ে এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারে।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেক কৃষক ঘরে চাল রাখে। খাদ্যের কোনো অভাব নেই। আপনাদের সব অসুবিধা আমরা দূর করব।’
সভায় ব্যবসায়ীরা চাল সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তায় চাল পরিবহনের অনুমতি চান। প্লাস্টিকের বস্তার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার দাবি জানান। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর দিয়ে ট্রেনে চাল পরিবহনের অনুমতি ও ব্যবসায়ীদের হয়রানি না করার দাবিও জানান।
এসময় সব পর্যায়ে চাল সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের অনুমোদন দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। একই সঙ্গে তিনি রহনপুর বন্দর দিয়ে ট্রেনে চাল আমদানির ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ারও আশ্বাস দেন।
আরএমএম/জেডএ/আইআই