রোহিঙ্গা নয়, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মানুষ
রোহিঙ্গা পরিচয় যার, তার ওপরই নির্যাতনের খড়্গ। রোহিঙ্গারা অবৈধ, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী, রোহিঙ্গারা বাঙালি- এমন অভিযোগ এনে মিয়ানমার সরকার আর বৌদ্ধরা মিলে তাদের দেশ ছাড়া করার মিশনে নেমেছে।
দেশটির সেনাবাহিনী যেন দুর্ভাগা ও নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের নিশানা করে রাইফেল তাক করে রেখেছে। সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মগ-মারমা সন্ত্রাসীদের হিংসার আগুনে জ্বলছে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাসহ সব রোহিঙ্গাগোষ্ঠী।
সেনাদের নিষ্ঠুর মননে রক্ষা পাচ্ছে না কোলের শিশু পর্যন্ত। নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। গুলির পর জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করছে বর্বর বৌদ্ধরা। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মেরে উল্লাস করছে। সেনা ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরাও।
গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে ছাইয়ের ভাগাড় বানিয়েছে বৌদ্ধ মগরা। লুট করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের শেষ সম্বলটুকুও।
নিঃস্ব অসহায় রোহিঙ্গারা সর্বাহারা হয়ে প্রাণ বাঁচাতে পাড়ি জমিয়েছে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে। কক্সবাজার আর বান্দরবানের সীমানা এখন রাষ্ট্রহীন মানুষের ঠিকানা। রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্র নেই, সরকার নেই। তাতে কী? রাষ্ট্রহীন এ মানুষরা মানুষকে পাশে পেয়েছে।
রোহিঙ্গা নয়, মানুষ হিসেবেই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এ দেশের মানুষ। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা। উখিয়া-টেকনাফ এখন যেন মানবিক সহযোগিতার এক অনন্য দৃষ্টান্তে রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ের অনেকেই বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে ছুটে আসছেন রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে। জরুরি খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওষুধ, পলিথিন, বাঁশসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে হতভাগা রোহিঙ্গাদের মাঝে। এসব সহায়তা পেয়েই বেঁচে থাকার স্বপ্ন ফিরে পাচ্ছেন তারা, অন্তত জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু মিলছে রোহিঙ্গাদের।
রোববার দুপুরে কথা হয় চট্টগ্রামের পূর্ব বাকালিয়ার বাইতুল মনসুর কমপ্লেক্স বণিক সমিতির সদস্য আমানউল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, কার পরিচয় কী, তার বিচার করে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় না। নিজেরা চাঁদা তুলে সাহায্য নিয়ে এসেছি। খাবার, পানি, কাপড়সহ বিভিন্ন উপকরণ বিলি করছি। এখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। মানুষগুলো বাঁচানোই এখন মানুষের দায়।
চিড়া, মুড়ি আর খাবার পানি নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিলি করতে এসেছে কক্সবাজার শেয়ারহোল্ডার গ্রুপ। গ্রুপের সদস্য মাসুদ রানা বলেন, মানুষের এমন দুর্দিনেও যদি পাশে না দাঁড়াই, তাহলে বিবেকের কাছে বন্দি থাকতে হয়। কত নির্যাতন আর নীপিড়নে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়েছে, তা এখানে এসে বুঝলাম।
রোহিঙ্গা নারী কদবানু ত্রাণ পেয়ে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘চারদিন আগে বালুখালী ক্যাম্পে এসেছি। কিছুই আনতে পারিনি। সাহায্য পেয়েই বেঁচে আছি। নিজ দেশের মানুষরা তাড়িয়েছে আর ভিন দেশিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইনে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরএসএ)। ওই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যসহ ৮৯ জন মারা যায় বলে মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য। এরপরই রাজ্যটিতে শুরু হয় সেনা অভিযান।
জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেনা অভিযানে এক হাজারের অধিক নিরীহ রোহিঙ্গা মারা গেছে। আর প্রাণ বাঁচাতে সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
এএসএস/এএইচ/এমএআর/আরআইপি