এক টুকরো পলিথিনই এখন সোনার হরিণ
সবই ছিল। এখন শুধুই হাহাকার। গোলা ভরা ধান আর মাঠ ভরা ফসল ছিল। ছিল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। এখন কিছুই নেই। ছলছল চোখের পানিই এখন ভরসা।
নয়নজুড়ে অমন অশ্রু দেখে কেউ করুণা করতে চাইলেই তার প্রতি রোহিঙ্গাদের কৃতজ্ঞতার শেষ থাকছে না। রোহিঙ্গা পাড়ায় সাহায্যের এক টুকরো পলিথিনই এখন যেন সোনার হরিণ।
পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই নেই তাদের। দেশ নেই, রাজা নেই। সবই কেড়ে নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। ভূমিপুত্র রোহিঙ্গাদের ভূমিহীন করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এপারে। যারা আসেনি, তাদের বিষয়ে কেউ কিছুই বলতে পারছে না। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে পালিয়ে এসে লাখো রোহিঙ্গা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনাহারে-অর্ধাহারে খোলা আকাশের নিচে এসব রোহিঙ্গা যেন সভ্যতার অভিশপ্ত কীটে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সড়কের দু’ধার অসহায় মানুষের চোখের জলে আজ সিক্ত।
রিফিউজি, উদ্বাস্তু, বাস্তুহারা, শরণার্থী- কত উপাধিই না মিলছে রোহিঙ্গাদের। শুধু মিলছে না মানবাধিকার। ঘর নেই, বসন নেই। খাবারের জন্য সর্বত্রই হাহাকার।
কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িজুড়ে এখন রাষ্ট্রহীন মানুষের মাতম। রোহিঙ্গাদের কান্নায় অভিশপ্ত হচ্ছে বিশ্বসভ্যতা, দলিত হচ্ছে বিশ্বমানবতা। প্রাণ ভয়ে নিজ দেশ ছেড়ে ভিন দেশে ঠাঁই নিলেও বেঁচে থাকাই আজ দায়।
ঘরহীন মানুষের ঠিকানা আজ পাহাড়ঘেঁষে। উখিয়া বাজার থেকে কুতুপালং, কুতুপালং থেকে বালুখালী রাস্তার দু’ধারে লাখো রোহিঙ্গা ঠাঁই খুঁজছে। ঠাঁই বলতে চার কোণায় চারটি খুঁটিতে পলিথিনের ঘর। তাও মিলছে না অনেকের। সব জায়গা আগেই দখল হয়ে গেছে। সহায়-সম্বলহীন রোহিঙ্গারা এখনও স্রোতের মতো আসছে। ঠাঁই না পেয়ে অনেকেই রাস্তার পাশে বসে-দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছেন। প্রাণ ভয়ে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা সীমানার কাছে অবস্থান নিয়েছে বলে জানান পালিয়ে আসা মানুষরা।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিদ্রাহীন কাটছে রোহিঙ্গাদের। প্রয়োজনের তুলনায় খাবার জুটছে না। জুটেছে না খাবার পানিও। এক টুকরো পলিথিনের জন্যও হাহাকার বইছে এখানে। কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে ঘর বানানোর পলিথিনের তীব্র সঙ্কট এখানে।
মিয়ানমারের মন্ড উপজেলা থেকে দুই নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আমেনা বেগম। ছেলে ও ছেলের বউ অন্য পয়েন্ট দিয়ে পার হয়েছে, খোঁজ মেলেনি তিনদিনেও।
আমেনা বেগম বলেন, জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছি। কোনো টাকা-পয়সা নেই। এক টুকরো পলিথিনও কিনতে পারিনি। বৃষ্টিতে ভিজেই রাত কাটাচ্ছি।
প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইনে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরএসএ)। ওই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যসহ ৮৯ জন মারা যান বলে মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য। এরপরই রাজ্যটিতে শুরু হয় সেনা অভিযান।
জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেনা অভিযানে এক হাজারের অধিক নিরীহ রোহিঙ্গা মারা গেছে। আর প্রাণ বাঁচাতে সর্বস্ব হারিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
এএসএস/এমএআর/আরআইপি