মেয়েকে ফিরে পেতে এক অসহায় বাবার অপেক্ষা!
মঙ্গলবার, দুপুর ২টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের তৃতীয় তলায় ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের একটি বেঞ্চে বসেছিলেন ৫০ বছরের এক বৃদ্ধ। নাম নান্নু মিয়া। বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার কালিখোলা গ্রামে। বেশভুষা অতি সাধারণ। পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি।
বৃদ্ধ বারবার ফরেনসিক বিভাগের একজন নারী চিকিৎসকের দরজার দিকে তাকাচ্ছিলেন। ভরদুপুরের কড়া রোদে ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ পরপর মাথায় হাত রাখছিলেন। ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল তাকে।
তার ঠিক পাশেই বসে থাকা মধ্যবয়সী মহিলাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, কখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ অইব। এরপর না-কি ওরে কোর্টে লইয়া যাইবো। হেইহানে আবার কতো সময় লাগবো? মাইয়াডারে কি আইজ বাড়িত লই যাইতে পারমো?
কৌতুহলবশত এ প্রতিবেদক এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলে নান্নু মিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি জানান, মোবাইলে পরিচয়ের সূত্র ধরে একই এলাকার এক প্রতারক যুবকের পাল্লায় পড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল তার পঞ্চম শ্রেণি-পড়ুয়া নাবালিকা মেয়েটি।
মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে নয়ন নামের ওই প্রতারক যুবক ঢাকায় এনে এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয় তার ছোট্ট মেয়েটিকে। এরপর গত দুইমাস মেয়েটিকে আটকে রেখে জোরপূর্বক দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হয়।
বৃদ্ধ জানান, শেরেবাংলানগর থানা পুলিশ তাকে জানিয়েছে, গত রোববার মিরাজ নামের এক দালাল তার মেয়েকে সংসদ ভবন এলাকায় নিয়ে আসে। সন্ধ্যা নেমে এলে দালাল বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চায়।
এ সময় তার মেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে সংসদ এলাকায় নিরাপত্তা প্রহরীরা ছুটে আসেন। মেয়েটি জানায়, গত দু`মাস যাবত একটি বাসায় আটকে রেখে তাকে দেহব্যবসায় বাধ্য করেছে এই যুবক। ঘটনা শুনে তাদের শেরেবাংলা নগর থানায় সোপর্দ করা হয়।
এক আত্মীয়ের মাধ্যমে খবর পেয়ে নান্নু মিয়া পাগলের মতো গ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন। কিন্তু আসার পর থেকে থানা ও মেডিকেলে দৌড়ঝাঁপ করে সময় কাটছে তার। না আছে খাওয়া, না আছে বিশ্রাম।
‘আমার নাবালিকা মাইয়াডারে নষ্ট করলো, তাদের কী বিচার অইবনা?’ বলেই বৃদ্ধ আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে মেয়েটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছিলেন ডা. রেজওয়ানা শারমিন লিমা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ভিকটিমের দেওয়া জবানবন্দি অনুসারে মেয়েটিকে দুই মাস ঘরে আটকে রেখে যৌন-নির্যাতন চালানো হয়েছে। আমরা তার বয়স নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি।
প্রাথমিক পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। নির্যাতনে মেয়েটি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছে বলে তিনি জানান।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মেয়েটি বলেন, নয়নের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনের মিসড কলের মাধ্যমে পরিচয় হয়। কথাবার্তার এক পর্যায়ে সে জানতে পারে নয়নের বাড়ি একই থানার টরকি গ্রামে।
ঢাকায় চাকরি ও বিয়ের কথা বলে নিয়ে এসে সে এক যুবকের কাছে তাকে বিক্রি করে দেয়। গত দুই মাসে তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নানা বয়সী লোকের সঙ্গে বিছানায় যেতে হয়েছে।
মেয়েটি জানায়, তার মতো আরো কয়েকজন মেয়েকে একটি ফ্ল্যাটে আটকে রেখে দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য করা হচ্ছে। অস্বীকৃতি জানালে নেমে আসতো নির্যাতন। বন্ধ করে দেওয়া হতো খাবার।
নান্নু মিয়া জানান, স্থানীয় থানায় মামলা করা হলেও পুলিশ নয়নকে খুঁজে পায়নি। পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে এ প্রতিবেদককে দেখিয়ে তিনি বলেন, যে মোবাইল নম্বর (০১৮৩৮২৯১৫৮০) থেকে তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতো সে নম্বরটি তার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে।
এমইউ/বিএ/আরআইপি/এসআরজে