নব্য জেএমবির গোপন প্রস্তুতি, আমিরকে নিয়ে ধোঁয়াশা
আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী ‘নব্য জেএমবি’ গোপনে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে সচেষ্ট রয়েছে। এজন্য তারা একাধিক গোপন বৈঠকও করছে।সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং অন্যান্য সূত্র থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রগুলো বলছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিদেশি নাগরিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে তৎপর রয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠনটি। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে রাজধানীর থানাগুলোতে বাড়তি সতর্কতা জারির নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
গুলশানে হলি আর্টিসানে হামলার আট মাসের মধ্যে নতুন নেতৃত্বে সংগঠিত হয় নব্য জেএমবি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে সংগঠনটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নিহত হলেও সাংগঠনিক তৎপরতা তাদের থেমে নেই।
উগ্রপন্থী এ জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রধানকে নিয়েও ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুটি সংস্থার কাছে থেকে এ বিষয়ে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। র্যাবের দাবি, জেএমবির নতুন আমির হলেন আবু মুহারিব। তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর হলেন সাজিদ।
অন্যদিকে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের দাবি, মুসা নিহত হওয়ার পর আইয়ুব বাচ্চু এখন নব্য জেএমবির প্রধান।
গত ৫ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, নব্য জেএমবির প্রধান মইনুল ওরফে মুসা মৌলভীবাজারের বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় নিহত হন। এরপর সংগঠনের হাল ধরেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি সাভারেই থাকতেন। গত ২৭ ও ২৮ মে সাভারে যে দুটি বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়, তার একটিতে থাকতেন আইয়ুব বাচ্চু। অভিযানের সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। অভিযানের খবর পেয়ে জঙ্গি মনির হোসেন দ্রুত আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রীকে অন্যত্র সরিয়ে দেন।
আইয়ুব বাচ্চু যে এখন নব্য জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তা কীভাবে নিশ্চিত হলেন- জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর নব্য জেএমবির দায়িত্ব নেন সারোয়ার জাহান। সারোয়ার নিহত হওয়ার পর নেতৃত্বে আসেন মইনুল ওরফে মুসা। মৌলভীবাজারের বড়হাটে পুলিশের অভিযানে মুসা নিহত হন। এরপর নেতৃত্বে আসেন আইয়ুব বাচ্চু।
মনিরুল বলেন, কথিত এই আইয়ুব বাচ্চু মূলত তৃতীয় বা চতুর্থ সারির নেতা। তিনি মুসার সহযোগী ছিলেন। মুসা যখন সংগঠনের আমির ছিলেন, তখন বাচ্চু ছিলেন নায়েবে আমির। মুসা নিহত হওয়ার পর নেতৃত্বশূন্যতায় বাচ্চুকেই হাল ধরতে হয়। বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, আইয়ুব বাচ্চুই তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার বয়স ২৬ থেকে ২৭-এর মধ্যে। বাচ্চুর ছবিও পুলিশ পেয়েছে।
মনিরুল ইসলাম ওই সময় জানান, নব্য জেএমবি প্রধান ‘আইয়ুব বাচ্চু’, এটি তার ছদ্মনামও হতে পারে। কারণ জঙ্গিরা তাদের অপতৎপরতা চালাতে একাধিক নাম ব্যবহার করেন।
এদিকে রোববার কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, জঙ্গিবাদে অস্ত্র ও অর্থসহায়তার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে পোশাক তৈরি কারখানার মালিক ইমরান আহমেদকে অস্ত্র ও এক সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে।
মুফতি মাহমুদ খান এ সময় দাবি করেন, গ্রেফতার ইমরান জেএমবির সারোয়ার-তামীম গ্রুপের শূরা সদস্য এবং ঢাকা মহানগর পশ্চিমের দাওয়াতি আমির। নব্য জেএমবিতে ইমরান আহমেদের সম্পৃক্ততা কতটুকু সে সম্পর্কে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আতিয়া মহলে অভিযানের আগে সাজিদ নামের এক ব্যক্তি পালিয়ে যান। তিনি ঢাকায় এসে ইমরান আহমেদের মহাখালীর বাসায় আশ্রয় নেন। সাজিদ জেএমবির নতুন আমিরের ঘনিষ্ঠ সহচর। নতুন এই আমিরের নাম আবু মুহারিব।
তিনি আরও বলেন, সাজিদ ছাড়াও জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেককেই ইমরান তার বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন এবং অর্থ সাহায্য করেছেন। এ তালিকায় জুন্নুন শিকদারও আছেন। ধারণা করা হচ্ছে জুন্নুন শিকদার সিরিয়ায় রয়েছেন। গত বছর র্যা বের অভিযানে আবদুল হাকিম গ্রেফতার হন। সম্প্রতি ইমরান আইনি সহযোগিতার জন্য আবদুল হাকিমের স্ত্রীকে দুই লাখ টাকা দেন।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের বক্তব্য অনুযায়ী, ৩ জুন নব্য জেএমবি প্রধান আইয়ুব বাচ্চুর তিন সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন মনির হোসেন ওরফে সুমন, তৌহিদুল ইসলাম ওরফে তুহিন ও কামাল হোসেন।
৫ জুনের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত মার্চ মাসে সিলেটের আতিয়া মহলে অভিযানের সময় আইয়ুব বাচ্চু সেখানেই ছিলেন। আতিয়া মহলের কাছাকাছি তার বাসা ছিল। সেখানে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে তিনি থাকতেন। আতিয়া মহলে অভিযানের পরে তিনি পরিবার নিয়ে পালিয়ে সাভারের গেন্ডা এলাকায় বাসা ভাড়া নেন।
ওই কর্মকর্তারা জানান, আইয়ুব বাচ্চু ঢাকার একটি ভালো কলেজে পড়তেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষ করার বছর দুয়েক আগে তিনি জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়ে ঘর ছাড়েন।
রোববার র্যা বের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান আটক ইমরান থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সাংবাদিকদের জানান, জেএমবির সারোয়ার-তামীম গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় শূরা সদস্য সাজিদকে বিভিন্ন সময় আশ্রয় ও অর্থসহায়তা করেন ইমরান। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এই সাজিদই সানজিদ ওরফে কামরান ওরফে লাল ভাই ওরফে হাবিবুর রহমান ওরফে কামরান ওরফে মামুন ওরফে রশিদ নামে পরিচিত।
সাজিদ বর্তমানে জেএমবির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তিনি জেএমবির মূল সমন্বয়কারী হিসেবে কেন্দ্রীয় আমির আবু মুহারিবের খুবই আস্থাভাজন। আবু মুহারিবের পরিকল্পনায় সাজিদ জেএমবির মূলধারা এবং বর্তমান ধারাকে একত্রিত করার প্রয়াস নিয়েছেন। এ লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন স্থানে জেএমবির শূরা সদস্যদের সঙ্গে গোপনে বৈঠকে মিলিত হন।
সাজিদের অবস্থান সম্পর্কে র্যাবের হাতে আটক ইমরান জানান, তাদের গোপন যোগাযোগের মাধ্যম -থ্রিমা গ্রুপে। গত ২৬ মে থেকে সাজিদের আইডি নিষ্ক্রিয়/উপস্থিতি লক্ষ্য করা করা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে সে নতুন কোনো নাশকতার প্রস্তুতি নিতে পারে- সংবাদ সম্মেলনে জানান মুফতি মাহমুদ খান।
জিজ্ঞাসাবাদে ইমরান সাজিদ সম্পর্কে আরও জানান, সাজিদ সিলেটের আতিয়া মহলে পুলিশের অভিযানের পূর্বে ওই স্থানে অবস্থান করছিল। ভাগ্যক্রমে তিনি অভিযানের পূর্বে আতিয়া মহল থেকে বের হয়ে আসেন। অতপর ঢাকায় ইমরানের মহাখালীর বাসায় আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে সাজিদকে নিয়ে ইমরান ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে নাশকতার পরিকল্পনা করেন।
র্যাবের দাবি, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর জেএমবির মূলধারাসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা একত্রিত হয়ে জেএমবির সারোয়ার-তামীম গ্রুপ তৈরি করে। তারা গুলশান ও শোলাকিয়ায় নাশকতা করে এবং পরবর্তীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে দলনেতাসহ অধিকাংশ উপরের সারির সক্রিয় সদস্য নিহত হন। গ্রেফতার হন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য। এ লক্ষ্যে সংগঠনের সদস্যপদ বৃদ্ধির জন্য আরও বেশি দাওয়াতের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় নব্য জেএমবির পক্ষ থেকে।
এ লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বগুড়ায় দাওয়াতি কার্যক্রমের উচ্চপর্যায়ের গোপন বৈঠক হয় এবং দাওয়াতি শাখার সাংগঠনিক কাঠামোর রদবদল করা হয়। বৈঠকে বিভিন্ন জেলা থেকে ৩০-৩৫ জন অংশগ্রহণ করেন।
বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি দাওয়াতি শূরা বোর্ড গঠন করা হয়। এতে দাওয়াতি আমির নির্বাচিত হন শায়েখ আরিফ, নায়েবে আমির নির্বাচিত হন শায়েখ এনামুল। এছাড়া র্যাবের হাতে আটক ইমরান আহমেদও শূরা সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্তসমূহ জেএমবির কেন্দ্রীয় আমির আবু মুহারিব কর্তৃক অনুমোদনের জন্য সাজিদের নিকট প্রেরণ করা হয় বলে র্যাবের দাবি।
র্যাবের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জেএমবির প্রধান শাখাসমূহ হলো- যথাক্রমে দাওয়াতি শাখা, সামরিক শাখা, অর্থ শাখা, মিডিয়া ও আইটি শাখা। এছাড়া সংগঠনে আরও দুটি বোর্ড রয়েছে যা শরিয়াহ বোর্ড ও আলেম বোর্ড নামে পরিচিত। জেএমবির কেন্দ্রীয় আমির নিজে অন্তরালে থেকে একজন বিশ্বস্ত সমন্বয়কারীর মাধ্যমে সংগঠনের সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। সাধারণত সামরিক শাখার আমিরই কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী হিসেবে নিযুক্ত হন বলে ইমরান র্যা বের জিজ্ঞাসাবাদে জানান। এছাড়া উইং বা শাখাগুলোর প্রধানরা কেন্দ্রীয় আমিরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।
ঢাকায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় টানা অভিযান ও নজরদারির কারণে জঙ্গিরা প্রস্তুতির জন্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও চট্টগ্রামকে বেছে নেয়। এর বাইরে খুলনা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজধানী ঢাকায় নব্য জেএমবি কিছু ‘সেফ হাউস’ বা আস্তানা গড়ে তুলেছে বলে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে তথ্য রয়েছে।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালের আগস্টের পর থেকে হলি আর্টিসানে হামলার আগ পর্যন্ত নব্য জেএমবির ১৫০ জনকে গ্রেফতার এবং বিভিন্ন অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে ও বোমা তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণে ১০ জন নিহত হন। হলি আর্টিসানে হামলার পর থেকে চলতি বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান, বন্দুকযুদ্ধ ও আত্মঘাতী হামলায় নব্য জেএমবির ৪৫ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে নব্য জেএমবির প্রথম পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন। এছাড়া আরও কিছু সদস্য গ্রেফতারও হন।
এআর/এমএআর/পিআর