সমুদ্রতীরের আকৃতিই বারবার ঘূর্ণিঝড়ের কারণ
বারবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এজন্য দেশের সমুদ্রতীরের আকৃতি ‘ফানেল’-এর মতো হওয়াকেই দায়ী করা হচ্ছে। এ কারণে সাগরে কোনো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে তা স্রোতের মতো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হনে।
বাংলাদেশ ছাড়াও উপসাগরীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর গতিপথের আওতায় রয়েছে ভারতের পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চল, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কাও। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উড়িষ্যায় ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হানলে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। আবহাওয়া অফিস বলছে, এজন্য এ অঞ্চলের নিচু সমতল ভূমি, ঘনবসতি এবং নিম্নমানের উপকরণে নির্মিত বাসস্থানই দায়ী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে ১০টি ঘূর্ণিঝড় হয়েছে তার মধ্যে ৫টিই হয়েছে বাংলাদেশে। এছাড়া আরও ১০ ঘূর্ণিঝড় রয়েছে যেগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
১৯৭০ সালে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া মহাপ্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়কে বিশ্বের সর্বকালের ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী ঝড় বলে সম্প্রতি ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ।
দেশের ইতিহাসে এ ঘূর্ণিঝড়টি সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী হয়েছে। এছাড়া এতে সম্পদও নষ্ট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী, চর বোরহানউদ্দিনের উত্তরাঞ্চল, চর তমিজুদ্দিন, হাতিয়া, মাইজদির দক্ষিণাঞ্চল ও হরিণঘাটায় আঘাত হানে। প্রচণ্ড বাতাসের তীব্রতা নিয়ে টানা দু’দিন অবস্থান ছিল ঘূর্ণিঝড়টির। ৩৬ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয় এতে।
ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১০ দশমিক ৬ মিটার। সরকারি হিসাবে এ ঘূর্ণিঝড়ে কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারান। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লক্ষাধিক মৎস্যজীবী। ৪৬ হাজার মৎস্যজীবী মাছ ধরার সময় মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়া এতে ১০ লাখের বেশি গবাদিপশুর মৃত্যু হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় চার লক্ষাধিক ঘরবাড়ি। শিক্ষাখাতেও বেশ প্রভাব ফেলে এই ঘূর্ণিঝড়। ৩ হাজার ৫শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়।
দ্বিতীয় ভয়ঙ্করতম অবস্থানে রয়েছে ভারতের হুগলী রিভার সাইক্লোন। এটি ১৭৩৭ সালে আঘাত হানে। বঙ্গোপসাগর থেকে উৎপত্তি হওয়া এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারান। বিধ্বস্ত হয় লাখো ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ও মৎস্য সম্পদ। এরপর রয়েছে ভিয়েতনামের হাইফং টাইফুন। এতে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা যান।
পরেই আছে ১৫৮৬ সালের বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন। ওই সাইক্লোনে ২ লাখ মানুষ মারা যান। এ ছাড়া ১৮৭৬ সালে আঘাত হানে গ্রেট বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন। মেঘনা মোহনা এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালী উপকূলে তীব্র ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন সংঘটিত হয়। এ ঝড়ের সঙ্গে ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১২ দশমিক ২ মিটার।
বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের জলস্রোত মেঘনার মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এতেও ২ লাখ মানুষ প্রাণ হারান।
এরপরই আছে, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ১৮৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়। এতে ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৭৫ সালের সুপার টাইফুন নিনা। চীনের এ ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখ ৭১ হাজার মানুষ মারা যান।
সাইক্লোন জিরো-টু বি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আঘাত হানে বাংলাদেশে। ঘটে যাওয়া এ ঘূর্ণিঝড়ে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এর মাঝে কিছু ঘূর্ণিঝড় হলেও, কোনোটি এটির মত ধ্বংসাত্মক ছিল না।
১৮৮২ সালে ভারতের গ্রেট বম্বের সাইক্লোনও মারাত্মক ধ্বংসাত্মক ছিল। প্রাণ হারান ১ লাখ মানুষ। শক্তিশালী ছিল জাপানের হাকাতা বে টাইফুনও। ১২৮১ সালের এ ঘূর্ণিঝড়ে ৬৫ হাজার মানুষ মারা যান। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নার্গিসের আঘাতে ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান।
ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়গুলো ছাড়াও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আরও বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে বড় ধরনের কোনো হতাহত না ঘটলেও সম্পতের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুনামির সংকেত ছিল। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। ইউএসএইডের তথ্য অনুসারে এ ঝড়ে ৩ হাজার ৩৪৭ জন মানুষ নিহত হয়। রিলিফ ওয়েবের প্রতিবেদন বলা হয়েছে ১০০১ জন মানুষের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘন্টায় ২১৫ কিলোমিটার।
২০০৮ সালের ২ মে গঠিত হয় ঘূর্ণিঝড় নার্গিস। একই বছরের ২৬ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় রেশমি আহত হনে উপকূলীয় অঞ্চলে। এতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
এরপর ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিজলী ও ২৫ মে উপকূলে আঘাত হানে আইলা। বিজলীতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আইলায় ১৯০ জন মানুষ প্রাণ হারান। এতে ক্ষতি হয় প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার রাস্তার।
২০১৩ সালের ১৬ মে আঘাত হানে মহাসেন। একই বছরের ৪ নভেম্বর আঘাত হানে হাইয়ান। ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় কোমেন। ২০১৬ বছরের ২১ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু।
সর্বশেষ আজ মঙ্গলবার সকালে উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোরা। এসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও এক সময় দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
এমএসএস/এনএফ/জেআইএম