নতুন আইনে ভ্যাট হার হচ্ছে ১২ শতাংশ!
নতুন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে নমনীয় হচ্ছে সরকার। নতুন আইনে সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের চিন্তা থেকে সরে এসে ১২ শতাংশ নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশের নিচে না নামানোর পক্ষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুসারে এ হার চূড়ান্ত করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসছে এনবিআর। বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বৈঠক হবে বলে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অর্থমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ বৈঠকেই বিতর্কিত ভ্যাট হার, ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা, কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো, সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো, সিগারেট ও বিড়ি শিল্পের মূল্যস্তর ও সম্পূরক শুল্ক হার, আবাসন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ সম্প্রসারিত করাসহ বেশকিছু জটিল বিষয়ের নিষ্পত্তি হবে। এ ছাড়া বৈঠকে ভ্যাট হার নিয়ে নতুন একটি প্রস্তাবও দেবে এনবিআর। এরপর এসব সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
নতুন আইনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের বিষয়ে প্রথম থেকেই তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন ব্যবসায়ীরা। এ আইন বাস্তবায়ন হলে মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী ১ জুলাই থেকে এই আইন বাস্তবায়নের বিষয়ে অনড় ছিল। এ অবস্থায় ভ্যাটের হার বাস্তবসম্মত করতে গত ১১ মে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ১৪ মে এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে চাচ্ছে না। এ জন্য ভ্যাটের বাস্তবসম্মত একটি হার নির্ধারণ করতেই এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
১৯৯১ সাল থেকে সর্বস্তরে সহনীয় হওয়ায় সর্বোচ্চ ভ্যাট হার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন সরকারের নীতি নির্ধারকরা। এনবিআরের প্রস্তাব ছিল একক ভ্যাট হার ১৫ শতাংশের স্থলে ১৩ শতাংশ করা। এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে এ বিষয়ে দ্বিমত থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এনবিআরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, কিছু কিছু বিষয়ে ১৫ শতাংশের একক ভ্যাট হার রাখতে চায় এনবিআর। তবে উৎপাদন ও সেবা খাতে যেসব ব্যবসায়ী রেয়াত নেয়ার সামর্থ্য রাখেন না তাদের জন্য থাকছে বিশেষ হ্রাসকৃত হার। এতে ক্ষুব্ধ ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, প্রস্তাবিত বাজেটে ১২৭টি পণ্য ও সেবাখাতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে। নতুন ভ্যাট আইনে এ ধরনের অব্যাহতির কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে নিত্যপণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেশ কিছু খাতের জন্য বিদ্যমান আইনে থাকা সংকুচিত ভিত্তিমূল্যের আদলে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট থাকার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
এনবিআরের প্রস্তাব অনুযায়ী, আড়াই কেজি পর্যন্ত প্যাকেটজাত বিভিন্ন নিত্যপণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে। অর্থাৎ একসঙ্গে আড়াই কেজির বেশি এসব পণ্য না কিনলে ভ্যাট দিতে হবে না। এ তালিকায় রয়েছে- মাংস, সব ধরনের সবজি, ফল, তরল দুধ, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, গম, আটা ইত্যাদি। এ ছাড়া আদা, জিরা, লবঙ্গ, ধনিয়া, দারুচিনি, এলাচসহ অন্যান্য মসলায় আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট থাকছে না।
পাশাপাশি পাটজাত পণ্য এবং কৃষি খাতে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের বীজ, সেচ ও কীটনাশক, ফুল ও ফুলের তোড়াসহ কিছু পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি থাকছে। ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত সরকারের ১০ প্রকল্প, হাইটেক পার্ক, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বা পিপিপিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা থাকছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। এ আইন অনুযায়ী সব ক্ষেত্রেই ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আরোপ করা হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাটের এ হার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। আর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়াবে। এ ছাড়া বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদেরও বেশ কিছু সমস্যা হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন আইন রেয়াত ও হিসাব নির্ভর। উৎপাদন, আমদানি, সরবরাহ এবং খুচরা-পাইকারি ব্যবসার প্রতি স্তরে রেয়াত বা ক্রেডিট নেয়ার সুযোগ আছে। এ সুবিধা নিতে হলে প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে লেনদেনের চালান বা ইনভয়েস অবশ্যই রাখতে হবে। এ জন্য আধুনিক তথা কম্পিউটার ব্যবহার করে হিসাব সংরক্ষণ করতে হবে।
তারা আরও বলছেন, বর্তমানে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালান রাখে এবং তাদের হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিক। সারাদেশে তাদের সংখ্যা মোট ব্যবসায়ীর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি ৮০ শতাংশই মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ী।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন যদি ১ জুলাই থেকেই বাস্তবায়িত হয় এবং ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশই থাকে তাহলে পণ্যের দাম শুরুতেই বেড়ে যাবে। যা ভোক্তাদের বেশ ভোগাবে।
তিনি আরও বলেন, মূসকের জন্য বাড়তি অর্থ দিতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতি হবে। অবশ্য পরে বাড়তি মূল্যেই পণ্যের দাম ঠিক হয়ে যাবে। রেয়াতি হারে মূসক রাখার পক্ষে আমি নই। মূসক সব ক্ষেত্রেই একই হারে হতে হবে। তবে ১৫ শতাংশ মূসক একটু বেশি। এটা ১০ শতাংশ করা উচিত।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ভ্যাটের হার নির্ধারণে এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের পর নতুন আইনে ভ্যাট হার ১২ শতাংশ নির্ধারণের চিন্তা করা হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করতে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। তবে জনগণের কষ্টের কথা মাথায় রেখে এ হার কিছুটা কমানো হতে পারে। তবে বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে চূড়ান্ত হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ১২ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে এবং তা হবে অভিন্ন বা একক রেট। এ ছাড়া ভ্যাট পরিশোধের লেনদেনের সীমা আরও বাড়িয়ে ছাড় দেয়া হবে। এ জন্য ভ্যাট আইন সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় পাস করার পর তা আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘোষণা করা হবে।
এমএ/এমইউএইচ/আরএস/পিআর