‘ধর্ষণ মামলা করতে যাওয়া, ধর্ষিত হওয়ার শামিল’
‘ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল আরও কয়েকবার ধর্ষিত হচ্ছি। পুলিশ বারবার একই ঘটনা (ধর্ষণের) শুনতে চাইছিল। অথচ অ্যাটেনটিভলি (মনোযোগ দিয়ে) শুনছিল না। গুরুত্বও দিচ্ছিল না।’
সোমবার (৮ মে) রাতে জাগো নিউজের কাছে এভাবেই মামলা করার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি রেস্টুরেন্টে ধর্ষণের শিকার দুই তরুণীর একজন।
আলাপকালে তার কথায় উঠে আসে তাদের প্রতি পুলিশের অবহেলা আর স্বেচ্ছাচারিতার কথা।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের এক কথা বারবার বলতে হচ্ছিল। বারবার ওরা (পুলিশ) ইনফরমেশন মিস করছিল। অনেকবার শোনার পরে একপর্যায়ে বললেন, এসব কথা লিখতে হবে। আমরা স্টেটমেন্ট লিখলাম। এরপরে বললেন- আপনারা আজ চলে যান, আমরা তদন্ত করব, যদি দেখি ওরা অপরাধী তাহলে আমরা মামলা নেব।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই তরুণী এ প্রতিবেদককে প্রশ্ন করেন, ‘এটা কি ধরনের কথা? ওরা অপরাধী দেখার পরে মামলা নেবে কেন? তবে কি ওরা কোর্টের কাজটি করছে, ব্যাপারটি এ রকম?’
তরুণী জানান, ‘সেদিন চলে আসি, পরদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদের আবার ডেকে পাঠায়। অথচ আগেরদিন এক ঘটনা অনেকবার করে বলে এসেছিলাম।’
‘পরদিন ডেকে আবার একই ঘটনা আবারও জিজ্ঞেস করেছে পুলিশ। বলেছে, এটা এটা আপনারা বলেন নাই, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি। তখন আমরা বলছি, আমরা কোন জিনিস বাদ দেই নাই। আপনারা মিস করেছেন, কারণ, আপনারা ইম্পর্টেন্স (গুরুত্ব) দেননি। আবার ডেকে আনছেন একই ঘটনা বলার জন্য।’-বলেন তিনি।
ওই তরুণী বলেন, ‘তার পরদিন আবারও ডেকে বলে প্রথমদিনের যে স্টেটমেন্ট লিখেছিলাম, সেটাতে কিছু কারেকশন আছে, আবার দেখে দেখে লেখেন। আবার লিখলাম। অনেক্ষণ বসিয়ে রেখে বলেছে, এই স্টেটমেন্ট টাইপ করতে হবে… এরকম হাবিজাবি..অনেক কিছু।’
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ওই তরুণী বলেন, ‘সেদিন মামলা নিয়েছে, কিন্তু আমাদের কোনো কপি দেয়নি। অথচ যে রিপোর্টাররা আমাদের বাসায় এসেছেন, তাদের প্রত্যেকের হাতে সেই মামলার কপি দেখেছি।’
থানার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পরদিন রাতে আমাদের ডাকা হলো, মামলার কপি দেয়ার জন্য। কিন্তু আমরা তো স্টুডেন্ট। আমাদের তো নরমাল লাইফ লিড করতে হবে। তো এরই মাঝখানে রাতে হুটহাট করে পুলিশের কাছে চলে যাওয়া…কঠিন। ঠিক আছে, তবু গেলাম।
যাওয়ার পরে উনি (পুলিশ কর্মকর্তা) আমাদের আটকে দিয়েছেন। আমাদের বলা হলো- ছবি তুলতে হবে। আমরা তো ব্যাপারটা ভয় পাই- ছবি তুলব, আবার কি হয় না হয়। তখন আমরা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ফোন করে বিষয়টি জানাই। আমরা বলেছি ছবি তুলব না। সেখানে কয়েকজন মহিলা পুলিশ ছিলেন, তারা আমোদের সঙ্গে রুঢ় হয়ে বলেন- এখনই ছবি তুলতেই হবে। আমরা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের প্রধান মিলি আপুর সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে চাইলাম, তখন ওই মহিলা পুলিশ বলে- কে মিলি আপু, কার কথা বলব। এখন ছবি তুলতেই হবে। এমন রুঢ় আচরণ করে যেন আমরা ক্রিমিনাল।’
তারপর মিলির সঙ্গে ওই নারী পুলিশ কথা বলে জানিয়ে তরুণী বলেন, ‘সেই রাতে আমাদের ওখানে থাকতে হবে বলে জানায় পুলিশ। আমরা বললাম, আপনারা তো আগে বলেন নাই, এভাবে বাইরে থাকলে বাড়িতে চিন্তা করবে। ওরা জানায়- আমাদের কিচ্ছু করার নেই। থাকতেই হবে। এটা নিয়ম, রুলস। পরে আমরা মিলি আপুকে জানাই। আমরা তো এত রুলস জানিনা। মিলি আপু জানান, ভিকটিমদের থানায় থাকতে হবে এমন কোনো রুলস নেই।’
‘পরে মিলি আপুকে ওই নারী পুলিশ বুঝিয়ে বলেন- ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য আমাদের সেখানে থাকতে হবে। ওইভাবে সুন্দর করে কথাগুলো যদি আমাদের বলতো, ভাল ব্যবহার করতো- তাহলে আমরা আগেই বুঝতে পারতাম। যাই হোক পরে অবশ্য আমাদের থানায় না রেখে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।’
ওই তরুণী বলেন, ‘আমরা প্রথমে যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন শুরুতে বেশ ভাল ব্যবহার করেছিল। আমরা অনেক সাহস পেলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা অন্যরকম আচরণ শুরু করে। হয়ত অভিযুক্তরা প্রভাবশালী জানার পর থেকে… শুনেছি তারা টাকাও খেয়েছে অনেক।’
তরুণী জানান, গত বৃহস্পতিবার প্রথমবার বনানী থানায় যান তারা। এরপর শনিবার মামলা নেয় পুলিশ। সেই রাতে তাঁদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়। পরদিন তারা বাড়ি ফেরেন।
গত ২৮ মার্চ রেইন ট্রি হোটেলে সাফাত আহমেদ নামে এক বন্ধুর জন্মদিনে যোগ দিতে এসে যোগসাজশে ধর্ষণের শিকার হন ওই দুই ছাত্রী। তাদের ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে রেগনাম গ্রুপের পরিচালক সাদমান সাকিফ, তার বন্ধু আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও আওয়ামী লীগের এক নেতার ছেলে নাঈম আশরাফের বিরুদ্ধে। গত শনিবার মামলা হলে দেশব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি হয়।
জেপি/এসআর/জেআইএম