ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

সমুদ্রেই স্বপ্নের সমাধি : থামছে না মানবপাচার

প্রকাশিত: ০৮:৪৯ এএম, ০৩ মে ২০১৫

মালয়েশিয়ায় সমূদ্রপথে থামছে না মানবপাচার। দিন দিন বেড়েই চলেছে এ যেন দেখার কেউ নেই। আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার নিরীহ যুবকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য সমুদ্রপথে পাড়ি জমাচ্ছেন। বেসরকারি উদ্যোগে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ বন্ধ থাকায় দালালদের প্রলোভনে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সমূদ্রপথে যাত্রা করছে এসব নিরীহ কর্মী।

সমুদ্রপথে ট্রলারে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে অনাহার ও তৃষ্ণার্ত অনেক অবৈধ কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। পাচারকারী চক্র মৃত কর্মীদের পেট ফেরে সাগরে ফেলে দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দালালদের হাতে খুন হন আড়াইহাজারের তিন যুবক তাদের কেউ অটোরিকশা চালাতেন, কেউ নসিমন আর কেউ রিকশা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বুক বেঁধেছিলেন তারা। বৈধ উপায়ে মালেয়শিয়া যেতে না পেরে অবৈধ উপায়ে সাগর পাড়ি দিয়েই যেতে চাইছিলেন সেই স্বপ্নের খোঁজে। কিন্তু সলিল সমাধি ঘটে গেল তাদের। এসব পরিবারে চলছে শোকের মাতম। সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা নেই কারও মুখে।

এর আগেও এই এলাকার অনেকের ভাগ্যেই এমন করুণ পরিণতি ঘটেছিল। কিন্তু সুখের আশা করে এসব হতদরিদ্র মানুষকে অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছে। আর এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন দালাল চক্র।
মালয়েশিয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে আগত একাধিক কর্মী এ তথ্য জানিয়েছেন। সমূদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রবেশের ঘটনা ঠেকানো সম্ভব না হওয়ায় মালয়েশিয়া ও বাংলাদেমের সর্ম্পক অবনতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন নিয়োগকর্তা সমুদ্রপথে আগত কর্মীদের স্বল্প মজুরিতে কাজ দিচ্ছেন। এতে বিপাকে পড়ছেন মালয়েশিয়ায় বৈধ বাংলাদেশি কর্মীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মালয়েশিয়ার সুবাংজায়ায় অবস্থানরত নরসিংদীর জুয়েল, (মোবাইল নং+৬০১১২৬২৭৭৬৮৬)। তিনি প্রতিমাসে সাগর পথে লোকজন নিয়ে আসেন। এতে বাংলাদেশে তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন তারই স্ত্রী শাহীনা আক্তার। দেশে টাকা পয়সা লেনদেন হয় তার স্ত্রীর ইসলামী ব্যাংকের ১১৮০৯ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। শুধু জুয়েলই নয় কক্সবাজারের শামছুলও রয়েছেন তার সঙ্গে। শামছুল থাকেন মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে। তার মোবাইল নম্বর হচ্ছে +৬০১০৯৬৮৭৬৯০।

এই দু`জন মালয়েশিয়ায় থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের লোকজনকে হাতিয়ে মালয়েশিয়ায় অবৈধ পথে নিয়ে আসে। বেশিরভাগই জানেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে তারা অনিশ্চিত পথে এগোচ্ছেন। তারপরও তারা অবৈধ পথ বেছে নেন। কুয়ালালামপুরের একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কর্মরত একাধিক কর্মী এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
        
২৪ এপ্রিল টেঘুরিয়াপাড়া গ্রামের কাউসার ও আলাল মালয়েশিয়া থেকে তাদের কাছে ফোন করে জানান, তারা অতি কষ্টে মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন। তবে তাদের সঙ্গে যাওয়া সাদেক, কবির ও সেলিমকে তাদের সামনেই দালালরা হত্যা করে সাগরে ফেলে দিয়েছেন। এ সংবাদ পাওয়ার পর ওই তিন যুবকের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। সাদেকের স্ত্রী শাহিদা, শিশুপুত্র সাব্বির (৫) ও শাহিনকে (৩) নিয়ে স্বামীর জন্য বিলাপ করছেন।

সাদেকের ভাই আনোয়ার হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে দালালরা আমাদের বলে আসছিলেন আমার ভাই সাদেককে মালয়েশিয়া নিয়ে গেছেন। কিন্তু ভাই ফোনে যোগাযোগ করেননি। এখন ভাইয়ের মৃত্যু খবর আসার পর দালালদের বাড়িতে গেলে জানা যায় দালালরা পালিয়ে গেছেন। এ দিকে প্রতি বছর ১০ হাজারের বেশি মিয়ানমার নাগরিক, বিশেষত মুসলিম রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিকে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের কুখ্যাত ওই মানব পাচার রুট দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়।

চাকরি দেওয়ার নাম করে এসব মানুষকে সমুদ্রপথে নৌকায় করে বিদেশ পাচার করে একটি চক্র। পথে নৌকায় চালানো হয় বিভিন্ন নির্যাতন। আবার অনেককে ওই এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প গেড়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। নির্যাতন ও খাবারের অভাবে অনেকে সমুদ্রেই মারা যান। ক্যাম্পে যাদের মৃত্যু হয় তাদের সেখানেই মাটির নিচে পুতে ফেলা হয়। আবার যাওয়ার পথে অনেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক হন।

এদিকে কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় গত তিন বছরে সহস্রাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এমন তথ্য জানিয়েছেন। সাগরে সলিল সমাধির আশঙ্কা, বিদেশের কারাগারের ভয়, খাবার ফুরিয়ে গেলে সমুদ্রপথে না খেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া, থাই কোস্টগার্ডের নির্যাতন জেনেও স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অনেক মানুষের কাছে ট্রলারে সমুদ্রপথে ‘ভয়ঙ্কর যাত্রা’ যেন কিছুই নয়।

এ জন্য থামছে না এ যাত্রা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ায় কিছুদিন পাচার কম হয়েছিল। ফের শুরু করেছে দালালচক্র। সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াগামী চারটি মানববাহী ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছে। এসব ট্রলারডুবির ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭ জন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও কয়েকশ’ মানুষ। শুধু কক্সবাজারের অধিবাসী শতাধিক যুবকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পাচার বন্ধে এখন সমুদ্রপথে মালয়েশিয়াগামীদের ভিকটিম বলে ছেড়ে দেয়ার বিপক্ষে মত দিয়েছেন অনেকে।

তাদের মতে, যারা সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন তাদের ‘সহপাচারকারী’ হিসেবে গ্রেফতার করে শাস্তি দিলে পাচার কমে যাবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৪ সালে প্রায় ৩৫০ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে চিহ্নিত দালালরা সব সময়ই থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় স্বচ্ছলতার আশায় অনেকের উন্নত দেশে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এক হাজার ৩০০ যাত্রীকে মালয়েশিয়া পাচারকালে উদ্ধার করা হয়।

‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির পরও নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচারে কক্সবাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে বলে তথ্যানুসন্দানে এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে। ‘বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কক্সবাজার থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের দূরত্ব কম।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের পর আর কোনো ভূমি নেই। সোজা সমুদ্রপথ। তাই কক্সবাজারকেই মানবপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এখানে এসে পর্যটক হিসেবে অবস্থান করে। পরে সুযোগ বুঝে দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। বর্তমানে সমুদ্রপথে মানব পাচারের সংখ্যা বেড়েছে। এ যেন দেখার কেউ নেই।
 
বিএ/পিআর