বন্যায় নতুন করে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও শতাধিক নতুন এলাকা-গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জমি।
সারাদেশে প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং মারাত্নক হুমকির মুখে ধানসহ নানা ফসল। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ত্রান কার্যক্রম পরিচালিত হলেও তা পরিস্থিতির তুলনায় অপ্রতুল।
অন্যদিকে ভারতের ‘গজলডোবা ব্যারেজের’ সব গেট খুলে দেয়ায় কাদামাখা পানি আসছে তিস্তায়, যা তলিয়ে থাকা ফসল মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে কয়েকটি জেলায় পানিবন্দী কয়েক লাখ মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বিশুদ্ধ পানি আর শুকনো খাবারের অভাবে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিশেষ করে দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণের জন্য হাহাকার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত নানা রোগ।
বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি :
বগুড়া
বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার রয়াদহ এলাকায় যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে প্রবল বেগে বন্যার পানি ঢুকতে থাকে। বন্যার পানিতে প্রায় ৫০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এরআগে বর্ষা মৌসুম শুরুর প্রথম থেকেই রয়াদহ এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি কয়েক দফা ধস নামে। ধস ঠেকাতে বালির বস্তা ফেলে তা মেরামতও করা হয়। কিন্তু গত দুই দিনে যমুনায় অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধিতে বাঁধটি ভেঙে যায়।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম সরকার জানান, এ এলাকায় বৃহস্পতিবার যমুনার পানি বিপদ সীমার ৮৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রাতেই বন্যার পানি রয়াদহ, শেখেরপাড়া, কড়িতলা, কুতুবপুর, দড়িপাড়াসহ ধুনট উপজেলা জোড়শিমুল, শিখাহাটি, সোনাগা, গজারিয়াসহ আশপাশের এলাকা প্লাবিত হয়।
কুড়িগ্রাম
ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আরও ২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৩৫ হাজার পরিবার। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সাহেবের আলগা, বুড়াবুড়ি, হাতিয়া ও বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলার ৭ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে।
ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গাধর, দুধকুমার, শংকোস ও ফুলকুমারসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়ছেই। পানির চাপে কালীগঞ্জের কুমরিয়ারপাড় এলাকায় নকুলারডারা ও বামনডাঙ্গার পানাতিটারীতে বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে আরো ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ৫ শতাধিক পুকুর তলিয়ে গেছে। এলাকায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। বানভাসিরা আগুন জ্বালাতে না পারায় পড়েছেন খাদ্য সংকটে। না খেয়েই দিন কাটছে তাদের। বানভাসিরা জানিয়েছেন, এ অবস্থায় তাদের শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি বেশি প্রয়োজন ।
নীলফামারী
তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি কিছুটা কমলেও ধেয়ে আসছে ঘোলা কাদাপানি। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, উজানে বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের কারণে ‘গজলডোবা ব্যারাজের’ সব গেট খুলে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ফলে কাদামাখা ঘোলা পানি প্রচণ্ড শব্দে আছড়ে পড়ছে তিস্তায়। প্রচণ্ড স্রোতে উজান থেকে মরা পশু-পাখির দেহ ও গাছ-পালা ভেসে আসছে।
ডালিয়াস্থ পাউবোর নির্বাহি প্রকৌশলী মাহাবুবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণে তিস্তা ব্যারেজের সবক’টি গেট খুলে রাখা হয়েছে। তবে রাতে পানি বাড়ার আশঙ্কা আছে। এদিকে তিস্তা পাড়ের পূর্ব-ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি, খালিশা চাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী, ডাউয়াবাড়ি-শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের অন্তত ২০ গ্রামের ২০-২৫ হাজার মানুষ বর্তমানে পানিবন্দী হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জ
বৃহস্পতিবার দুপুরে ১৮ সে.মি বেড়ে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার সাত উপজেলার ৪৬ ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। অনেক স্থানে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। জেলার অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল এখন পানির নিচে। কিছু ত্রাণ বিতরণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য।
যমুনা ও করতোয়া নদীতে নতুন করে পানি বৃদ্ধির ফলে উল্লাপাড়া উপজেলায় নতুন করে আরও ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বড়পাঙ্গাসী, উধুনিয়া, লাহিড়ী মোহনপুর, বাঙ্গালা ও দুর্গানগর ইউনিয়নের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
জামালপুর
যমুনা নদীর পানি বেড়েই চলেছে। তলিয়ে গেছে দেওয়ানগঞ্জ বাহাদুরাবাদ ঘাটের রেল ইয়ার্ড স্টেশন। উপজেলার কয়েক হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বানভাসি লোকজন জানান, তারা গতকাল পর্যন্ত কোন ত্রাণ পাননি।
গাইবান্ধা
বৃহস্পতিবার ঘাঘট নদীর পানি ৩৬ সে.মি., ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ২২ সে.মি., তিস্তা নদীর পানি ৩০ সে.মি. এবং করতোয়া নদীর পানি ৩২ সে.মি. বেড়েছে। এতে জেলার চারটি উপজেলার ২৯ টি ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। দুই হাজার ৫৯১ হেক্টর জমির রোপা আমন ও অন্যান্য ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৭৮ টি সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ের পাঠদান অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। এদিকে ফুলছড়ি উপজেলার সিংড়িয়া এলাকায় নদী ভাঙনে ৩৫টি ঘর বিলীন হয়ে গেছে।
টাঙ্গাইল
গত ২৪ ঘণ্টায় টাঙ্গাইলে যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে টাঙ্গাইল জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে টাঙ্গাইল সদর, ভুঞাপুর, গোপালপুর, কালিহাতী, নাগরপুর ও দেলদুয়ার উপজেলার তিন শতাধিক গ্রাম বন্যা কবলিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এছাড়া বন্যায় চলতি মৌসুমের প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমির আউশ ও আমন ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
এদিকে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একশ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন।
অপরদিকে, জেলার নাগরপুর, ভূঞাপুর ও গোপালপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভায়বহ রূপ ধারণ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে নাগরপুর উপজেলার মোকনা, ভাড়রা, সলিমাবাদ, সহবতপুর, গয়হাটা ও দপ্তিয়র ইউনিয়নের ৫ শতাধিক বাড়িঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে গৃহহীন হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। বন্যায় ঘরবাড়ি হারানো অনেকেই সরকারি খাস জমি ও গাইড বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।
কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ি ইউনিয়নে ধলেশ্বরী ও যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির সাথে ভাঙনের তীব্রতাও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যেই উপজেলার ৭টি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। গ্রামগুলো হলো বেলটিয়া, শ্যামসোল, আলীপুর, বল্লভবাড়ি, বেনুকুর্শা, কুর্শাবেনু ও বেড়ামারুয়া। ফলে প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।
এছাড়া নদীভাঙনে এ এলাকার আরো কয়েকটি গ্রাম বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে ও ৮টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে।
একই চিত্র ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলাতেও। যমুনায় ভাঙনের মুখে পড়েছে গোপালপুরের ঝাওয়াইল ও হেমনগর ইউনিয়নের ৪টি গ্রাম। এসব এলাকায় বন্যাকবলিত মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করলেও সরকারি কোনো সাহায্য এসে পৌঁছেনি।
যশোর
শার্শা উপজেলার কোদলা, বেতনা ও ভারতের ইছামতি নদীর সংযোগ খালগুলোতে মাটির বাঁধের কারণে জোয়ারের পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় এ সব অঞ্চলের নিচু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
শরীয়তপুর
পদ্মার পানি সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপদসিমার ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার জাজিরা উপজেলার চিটার চর এলাকায় ও নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ১০টি গ্রামের ৪ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।