ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

বেড়েছে কিশোর অপরাধ, সক্রিয় ৩৫ গ্রুপ

প্রকাশিত: ০৩:৩১ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০১৭

এলাকার বখে যাওয়া কিশোরদের সংস্পর্শে এসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে উঠছে। তারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোরদের এমন ৩৫টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

এক সময় কিশোর অপরাধ বলতে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেদের ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই, খেলার মাঠে মারামারি, মাদক গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়াচ্ছে। অপরাধের ধরনও বেশ পাল্টেছে আগের তুলনায়। এখন আর ছোটখাটো অপরাধেই সীমাবদ্ধ নেই তারা। নিজ নিজ এলাকায় গ্রুপ তৈরি করে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেউ তাদের কাজে বিরোধিতা করলে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না কিশোররা।

চলতি বছরের শুরুতে কিশোর অপরাধের আলোচিত ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর উত্তরায়। সেখানকার কিশোরদের দুই দলের বিরোধের জেরে ৬ জানুয়ারি খুন হয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবীর। এ ঘটনার ১২ দিনের মাথায় তেজগাঁওয়ের তেজকুনীপাড়ায় ‘কে বড়, কে ছোট’ এ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে খুন হয় আবদুল আজিজ নামে এক কিশোর। এ দুটি ঘটনার মধ্যে ১৫ জানুয়ারি রূপনগরে এক স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে একদল কিশোর।

আদনান কবীর হত্যার পর তদন্তে মাঠে নামে গোয়েন্দা দল। তাদের তদন্তে বিভিন্ন কিশোর গ্রুপের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। কিশোর অপরাধের নানা কারণও খুঁজে বের করেন গোয়েন্দারা।

আদনান কবীর হত্যার পরপরই উত্তরায় কিশোরদের ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিস্কো বয়েজ’ নামে দুটি গ্রুপের সন্ধান পান গোয়েন্দারা। এরপর তদন্তে বেরিয়ে আসে একাধিক গ্রুপের নাম। ফেসবুকের ওই দুটি গ্রুপ ছাড়াও উঠে আসে অন্তত পাঁচটি সক্রিয় গ্রুপের নাম। এসব গ্রুপের সদস্যদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ‘বিগবস’, ‘ডিসকো বয়েজ উত্তরা’, ‘পাওয়ার বয়েজ উত্তরা’, ‘নাইন এম এম বয়েজ উত্তরা’ ও ‘নাইন স্টার’- এ পাঁচটি গ্যাংয়ের মধ্যে প্রায়ই মারামারি, অস্ত্র প্রদর্শন ও এলাকা দখলের লড়াই লেগে থাকত। মাদকাসক্ত এসব সদস্য প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং নামকরা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ নায়েব আলী স্বাক্ষরিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শহর-নগরকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজের কিশোর ছাত্ররা তাদের সমবয়সী বখাটে কিশোরদের সঙ্গে মিলে ভয়ানক হয়ে উঠছে। লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে এসব কিশোরের অধিকাংশই উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক সময় বিত্তশালী বাবা-মায়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অনেক কিশোর বখে গিয়ে গ্রুপ তৈরি করে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে উঠছে। এদিক-সেদিক ঘোরাফেরার পাশাপাশি পাড়ার বড় ভাইদের সহায়তায় স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা ধারাল অস্ত্র বহনপূর্বক মাদক গ্রহণ ও ব্যবসা, ইভটিজিং, এমনকি হত্যাসহ নৃশংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন স্থানে একাধিক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বা প্রতিহিংসামূলক আচরণের কারণে বিভিন্ন সময় হত্যার মতো ঘটনাও সংঘটিত হচ্ছে। ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন শহর স্কুল, এলাকা বা নিজস্ব নামে এ ধরনের প্রায় ৩৫টি গ্রুপ গড়ে ওঠার তথ্য পাওয়া গেছে।

কিশোর অপরাধ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান বলেন, কিশোরদের অন্যায়-অপরাধে জড়িয়ে পড়ার নানা কারণ রয়েছে। উল্লেখিত কারণগুলো আংশিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজের ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারা, সামাজিক বিভিন্ন অবক্ষয়ের কারণে কিশোর অপরাধের ঘটনা যেমন বাড়ছে তেমনি এর ধরনও পাল্টাচ্ছে।

উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসিবে তিনি বলেন, তাদের অভিভাবকরা নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছেন। তাই তাদের সন্তানরাও সেদিকে ধাবিত হচ্ছে।

এখান থেকে ফিরে আসার উপায় হিসেবে তিনি বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, অপরাধী যেই হোক তার সঠিক বিচার নিশ্চিত করা, সমাজের সর্বত্র স্বচ্ছতা ও নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত মাত্রার হয়রানি বন্ধ করা, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষার ব্যবস্থা করা সর্বোপরি মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা গেলে সমাজের সব অন্যায়-অপরাধ বন্ধ হবে।

এদিকে কিশোর অপরাধ বন্ধে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- শিক্ষার্থীদের অপরাধের বিষয় নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং তাদের কাউন্সিলিংয়ের উদ্যোগ নেয়া; আলাদা আলাদা গ্রুপের কিশোরদের চিহ্নিত করে তাদের গতিবিধি সম্পর্কে পিতা-মাতাকে অবহিত করা; এসব বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন ও পরামর্শ দেয়া; অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত বিভিন্ন গ্রুপের নেতৃস্থানীয়দের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ; মাদক ও জঙ্গিবাদের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়মিত স্কুল-কলেজে সচেতনামূলক কর্মশালার আয়োজন করা; ক্লাসের পাঠ্যসূচির বাইরে সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে শিক্ষক/শিক্ষিকাদের নির্দেশনা দেয়া, মহল্লায় মহল্লায় রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রশাসনের সমন্বয়ে সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, এলাকাভিত্তিক পর্যাপ্ত খেলার মাঠসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের অভিভাবক বা পৃষ্ঠপোষকদের স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সতর্কতাসহ নিজ নিজ সন্তানদের প্রতি আরও যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা ওই প্রতিবেদনে।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাত আহমেদ বলেন, কিশোরদের নানা অন্যায়-অপকর্মে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি সমাজের নতুন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা প্রতিবেদন পেয়েছি। সেটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) পাঠান হয়েছে। এটি মাঠপর্যায়ে পাঠানসহ সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

তবে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত মাউশিতে এ প্রতিবেদন পৌঁছায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন মহাপরিচালক প্রফেসর ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান।

দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। সেখানে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলার আর ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা।

সমাজসেবা অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে ৫৯৭ জন কিশোর অবস্থান করে। তাদের মধ্যে ১২০ জন হত্যা মামলার আসামি। ১৪২ জন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা মামলা এবং নয়জন তথ্যপ্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফি আইনে করা মামলার আসামি। এর বাইরে চুরির মামলায় ৮৯, ডাকাতি ১৬, ছিনতাই ৬, মাদক মামলায় ৬৬, অস্ত্র মামলায় ২০ ও বিস্ফোরক মামলায় পাঁচজন।

অন্যরা সাধারণ ডায়েরিসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু অপরাধে জড়ালে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়।

এমএইচএম/এমএআর/জেআইএম

আরও পড়ুন