‘যার কাছ থেকে যা নেয়া যায়, মামা’
রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে চলছে ইচ্ছামাফিক ভাড়া আদায়। দূরত্ব মেপে ভাড়া পরিশোধের প্রবণতা ঢাকার যাত্রীদের মধ্যে কমই আছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ‘যার কাছ থেকে যত আদায় করা যায়’ স্টাইলে ভাড়া নিচ্ছেন বাসের কন্ডাক্টররা।
যাত্রীদেরও বাধ্য হয়ে সেই ভাড়া পরিশোধ করতে হচ্ছে। রাজধানীর মিরপুরের পূরবী বাসস্টপেজ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা; মিরপুরের পূরবী সিনেমা হলের বিপরীত পাশের বাসস্টপেজ থেকে ‘স্বাধীন এক্সপ্রেস’ নামক পরিবহনে ওঠার অভিপ্রায়। মিরপুর-১২ নম্বর থেকে গুলিস্তান হয়ে বাবুবাজার মাওয়াঘাট পর্যন্ত যায় বাসটি। উঠতে গিয়েই বাধার সম্মুখীন হতে হলো।
কন্ডাক্টর জানতে চাইলেন, কোথায় যাবেন। গুলিস্তানের কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘ছিট খালি নাই।’
পেছনে থাকা এক লোক বললেন, সিট না থাকলে তোর সমস্যা কী? এখন তো লোকাল, সবাই যেতে পারবে। চালক বললেন, ‘ওই ব্যাটা উঠতে দে।’
বাসে উঠে দেখা গেল, অর্ধেকের বেশি সিট খালি। বাসের মাঝামাঝি সিটে বসলাম। যথারীতি বাস চলছে, যাত্রী উঠছে। শেওড়াপাড়া পর্যন্ত আসতেই কানায় কানায় ভরে গেল বাস। কিন্তু বাসের যেন গতি নেই।
এক যাত্রী বাস কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে বললেন, ওই মামা। বাস যাচ্ছে না কেন? রাস্তা তো ফাঁকা। কন্ডাক্টরের সাফ জবাব- ‘লোকাল বাস, পুরা প্যাকেট না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই যাবে।’
আগারগাঁও সিগনাল পার হওয়ার আগেই বাসের সামনের দিকে ‘হাউকাউ’ শোনা গেল। ভাড়া নিয়ে চলছে বাদানুবাদ। এক সময় বাসের মাঝখানে চলে আসলেন কন্ডাক্টর। এ প্রতিবেদকের সামনের সিটে বসা এক যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া নিলেন।
স্টুডেন্ট ভাড়া রাখো মামা। এ বাসে স্টুডেন্ট ভাড়া কাটা হয় না। দাঁড়িয়ে থাকা একজন আধাপাকা দাড়িওয়ালা লোক বললেন, ‘কাটবি না ক্যান? এখন লোকাল। সব আইন মেনে ভাড়া কাটবি।’ এরই মধ্যে পুরো টাকা পরিশোধ করল স্টুডেন্ট যাত্রী। এবার আধাপাকা দাড়িওয়ালা লোকটি বললেন, ‘আগের স্টুডেন্ট এখন আর নেই। আগে ন্যায্য অধিকার নিয়ে ছাত্ররা কথা বলত। এখন খালি ফেসবুক। এটা নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত, অন্যদিকে মন নাই।’
এবার স্টুডেন্টের পাশের যাত্রীর ভাড়া দেয়ার পালা। উনি যাবেন বাবুবাজার ব্রিজের ওপারে। মিরপুর থেকে ৩৫ টাকা ভাড়া নিল কন্ট্রাকটর। যাত্রীর প্রশ্ন, এত ভাড়া কেন। এবার পাঁচ টাকা ফেরত দিল কন্ট্রাকটর। যাত্রী বললেন, ‘না ভাড়া আরও কম।’ কন্ট্রাকটরের পাল্টা প্রশ্ন, ‘ঠিক কোথায় নামবেন বলেন তো।’ বাবু বাজার ব্রিজের ওপারে।
কন্ট্রাকটরের জবাব, ‘আমরা ওপারে যাত্রী নেই না।’ এবার ক্ষেপে গেলেন যাত্রী। ‘নেই না মানে। এখন কি সিটিংয়ের নামে চিটিংয়ের যুগ আছে। ন্যায্য ভাড়া নে।’ আরও পাঁচ টাকা ফেরত দিলেন কন্ট্রাকটর।
এবার জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের পালা। ১০০ টাকা নোট দিলাম। কোথায় যাবেন? ‘গুলিস্তান, উঠেছি মিরপুর থেকে।’ ৭৫ টাকা ফেরত দিল। কত রাখলা? ২৫ টাকা। কেন? কত রাখব- জানতে চাইল কন্ট্রাকটর। ন্যায্য ভাড়া রাখো। এবার পাঁচ টাকা ফেরত দিল। এটা কি ন্যায্য ভাড়া? বললো, হ্যাঁ। তাহলে আগে পাঁচ টাকা বেশি রাখছিলা ক্যান?
‘মামা, যার কাছ থেকে যা নেয়া যায়। ভাড়া তো সবাই বেশি দেয় না। অনেকে কমও দেয়। সেটা তো পোষাতে হবে’- সরল জবাব কন্ট্রাকটরের।
পাশের যাত্রী বললেন, ‘তোরা তো কখনো ভাড়া কম নিস না। এখন এ উসিলাতে অন্যজনের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নিবি?’
‘নেব না তো কি করব, পকেট থেকে দেব নাকি’- পাল্টা জবাব কন্ট্রাকটরের।
এভাবে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই চলছে রাজধানীর গণপরিবহনগুলো। ভাড়া আদায়ে নিয়মনীতি থাকলেও কেউ তা মানছেন না। যাত্রীদেরও ভাড়া নিয়ে সঠিক ধারণা নেই। ফলে প্রতিনিয়ত ঠকতে হচ্ছে তাদের।
পাশের যাত্রী জানতে চাইলেন, ভাই বাস লোকাল হয়ে ভাল হয়েছে না। বললাম, আপনার কি মনে হয়? তিনি বললেন, অনেক ভাল হয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে যদি নীতি-নৈতিকতা থাকত তবে কতই না ভাল হতো।
সকাল ১০টায় গুলিস্তান পৌঁছালাম। বাস কন্ট্রাকটরের যথারীতি চিৎকার, ‘এই মাওয়া মাওয়া, ছেড়ে গেল মাওয়া।’
এমএ/এমএআর/আরআইপি