মানবপাচারকারীদের হাত থেকে পালিয়ে আসার গল্প
মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদের নির্যাতনের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক থেকে অনেক শ্রমিক দেশে পালিয়ে আসছেন। এখনও সে দেশে অনেক বাংলাদেশি আটক অবস্থায় আছেন বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা বাংলাদেশিরা। সম্প্রতি জীবন নিয়ে পালিয়ে দেশে ফিরেছেন আব্দুর রাজ্জাক, নওয়াব আলী, মহিদুল ইসলাম, নাইম হোসেনসহ আরও অনেকে।
ইরাকের দুর্গম ও নির্জন মরুভূমিতে আব্দুর রাজ্জাক ও নওয়াব আলীকে আটকে নির্যাতন করেই থেমে থাকেনি মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা নজরুল ইসলামের লোকেরা। নির্যাতনের ছবি দেশে পাঠিয়ে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণও আদায় করা হয়েছে।
শনিবার দুপুরে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের কবল থেকে মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফেরা শেরপুরের নকলা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল লতিফ নির্যাতনের বর্ণনা দেন। এ সময় দেশে ফেরা আব্দুর রাজ্জাক, নওয়াব আলী, মহিদুল ইসলাম, নাইম হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
তারা জানান, ভুক্তভোগী এসব শ্রমিক তাদের স্বজনদের মাধ্যমে দেশে থাকা চক্রের দালালদের হাতে বাধ্য হয়ে তুলে দিচ্ছেন মুক্তিপণের টাকা। ইরাকে মুক্তি পাওয়া এসব শ্রমিকের কেউ কেউ দেশে ফিরলেও বেশিরভাগই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আব্দুল লতিফ বলেন, গতবছর আমিসহ আরও ৩৩ জন শ্রমিক রাজধানীর উত্তরার মেট্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম ও তার সহাযোগী হুমায়ুন, চুন্নু ও হানিফের কাছে নগদ ৪২ লাখ টাকা দেন ইরাক যাওয়ার জন্য। প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে মর্মে স্টাম্পে চুক্তিনামাও করা হয়। পরে এই ৩৩ জনের মধ্যে ইমন তালুকদার, হারিছ উদ্দিন, মনু মোল্লা, নাসির মন্ডল ও মো. সাজনকে ইরাকে পাঠানো হয়। এই পাঁচ শ্রমিক ইরাক বিমানবন্দরে পৌঁছালে রিক্রুটিং এজেন্সির কোনো প্রতিনিধি তাদের রিসিভ না করে একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র তাদের মরুভূমিতে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে। পাশাপাশি তাদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। এই নির্যাতনের ছবি তুলে দেশে থাকা স্বজনদের দেখিয়ে বিকাশের মাধ্যমে সাড়ে ছয় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। পরে ওই পাঁচজন পালিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তিনি জানান, গতবছর মে মাসে আরও ৩৮ জনকে একইভাবে ইরাকে পাঠায় ওই রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক নজরুল ইসলাম। তাদেরও একইভাবে মরুভূমিতে আটকে রেখে নির্যাতন করে নির্যাতনের ছবি দেশে থাকা স্বজনদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখিয়ে টাকা দাবি করে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। বেশিরভাগ শ্রমিক প্রাণ বাঁচাতে দাবিকৃত মুক্তিপণের টাকা তাদের স্বজনদের মাধ্যমে বিকাশের মাধ্যমে নজরুলের লোকদের হাতে তুলে দেয়। পরে সেখান থেকে মুক্তিপণ দিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে মো. নওয়াব আলী, আব্দুর রাজ্জাক, মজনু মিয়া, রমজান আলী বাবুল বাংলাদেশে ফেরত আসেন।
এছাড়া গতবছর ২৪ এপ্রিল গাইবান্ধার আব্দুল মাজেদ, মতিন, মাইনুলকে ইরাকে পাঠানো হয়। তাদের কাছ থেকেও একইভাবে আটকে রেখে টাকা আদায় করে নজরুল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেশে ফেরত আসেন। এখনও অনেক শ্রমিক ইরাকে আটক অবস্থায় রয়েছেন।
তিনি আরও জানান, এদিকে এসব কাহিনী ইরাকে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট জমা দেয়া অন্য শ্রমিকরা জানতে পেরে তাদের পাসপোর্ট ফেরত চাইলে নজরুল নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছে। পাশাপাশি নজরুল ও তার ভাই মফিজসহ তাদের সহাযোগীরা সৌদি পাঠানোর কথা বলে আরও টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি সিআইডিতে স্থানান্তর করা হলে ইন্সপেক্টর নুরে আলম নজরুলের উত্তরা অফিসে অভিযান চালিয়ে ১৯৩টি পাসপোর্ট ও চুক্তিনামার কাগজপত্র জব্দ করেন। কিন্তু এই জব্দ করাই শেষ হয় সিআইডির কার্যক্রম। নজরুল বহাল তবিয়তে অফিস করছে এখনও। আর সিআইডির কর্মকর্তা নানা তালবাহানায় সময়ক্ষেপণ করছেন।
পাচারকারী চক্রের হোতা নজরুল, মফিজ ও তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী আব্দুল লতিফ। তিনি নিরীহ শ্রমিকদের উদ্ধারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
আরএম/এমআরএম/বিএ/আরআইপি