মাকে নিয়ে হজের ইচ্ছা পূরণ হলো না লে. কর্নেল আজাদের
মাকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। মায়ের আদেশের বাইরে কিছুই করতেন না। এ বছরই মাকে নিয়ে হজ পালনে সৌদি আরবে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। এজন্য একটি এজেন্সির মাধ্যমে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে টাকা জমা দিয়ে প্রাক-নিবন্ধনও করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণে স্প্লিন্টারের আঘাতে মারা যান তিনি। মাকে নিয়ে হজ করার আশা অপূর্ণই থেকে গেল লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের।
রোববার দুপুরে রাজধানীর মিরপুর-২ এর বড়বাগে অবস্থিত লে. কর্নেল আজাদের নির্মিত নিজ বাসায় গেলে কথা হয় ছোট ভাই ইউসুফ হাসান হিমেল ও মা সায়েদা করিমের সঙ্গে। জাগো নিউজকে সায়েদা করিম বলেন, ২২ মার্চ রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত সোয়া ১২টার দিকে আজাদ বাসায় আসে। কিন্তু আমি ঘুমিয়ে পড়ায় ডাকেনি। হিমেলের শিশুসন্তানের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি রাসেল (লে. কর্নেল আজাদের ডাক নাম) বাসায় ফিরেছে। ঘুম থেকে উঠতেই জড়িয়ে ধরে সে। আমি বলি বাবা এতো রাতে বাসায় ফিরলে যে! রাসেল বলে, ‘মা, ভালো লাগছিল না। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই চলে আসলাম। আবার কাজের কারণে আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। ক’দিন দেরিও হতে পারে। তোমাকে না দেখে, না বলে তো বাইরে যেতে পারি না মা!’ স্মৃতিচারণ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা সায়েদা করিম।
বলেন, ‘সেই রাতে রাসেলের সেসব কথা এখনও আমার কানে বাজে। ওই দেখাই যে শেষ দেখা, ওই কথাই যে শেষ কথা তা বুঝিনি ঘূণাক্ষরেও। ওই রাতে রাসেল আমার সাথে হজের বিষয়ে কথা বলে। জানায়, হজ বাবদ টাকা জমা দেয়ার কথা।’
মা সায়েদা করিম বলেন, ‘রাসেলকে একদিন বললাম, আমার শরীর ভালো না, হজে কি যাওয়া হবে না বাবা? সে নিষেধ করেনি। বলেছিল, এবারই তোমাকে হজে নিয়ে যাব।’
এরপর এজেন্সির মাধ্যমে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে মা ও নিজের জন্য টাকা জমা দিয়ে প্রাক-নিবন্ধন সম্পন্ন করেন আবুল কালাম আজাদ।
২২ মার্চ রাতে আজাদকে বললাম, ‘আমার তো শরীর ভালো না, আমার সাথে চলতে গেলে তোমার হজও ভালোভাবে হবে না বাবা। ও (আজাদ) বলে, মা তোমার বয়স হয়েছে, তোমার হজ করা আবশ্যক। আমি পরে না হয় আবার হজে যাব। তবে তোমাকে এবার হজে নিয়ে যাবই।’
‘আমার ছেলে, আমার মানিক আমাকে হজে নিতে পারল না। দেশের জন্য জীবন দিল। জঙ্গিরা ওর চোখ ঝাঁঝরা করে দিল। ওই চোখে আমাকে সর্বশেষ দেখেছিল আজাদ। ও বলত, মা তোমার কী লাগবে শুধু বলবা, সব করব তোমার জন্য। ইচ্ছে হলে তুমি আমার কলিজার উপর দিয়া হাঁটবা। তুমি কষ্ট পেলে তো আমার জীবনই বরবাদ।’
‘আমি গর্বিত মা, আমি সুসন্তানের মা, সৎ সন্তানের মা। দেশের জন্য জীবন দেয়া সন্তানের মা আমি। আমার মতো সন্তান যেন সব মাই গর্ভে ধারণ করে। আমার রাসেলকে আল্লাহ যেন জান্নাত নসিব করেন’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন লে. কর্নেল আজাদের মা সায়েদা করিম।
ছোট ভাই ইউসুফ হাসান হিমেল বলেন, ‘বড় ভাই হিসেবে তিনি কখনও বাবার অভাব বুঝতে দেননি। বড় ভাই হলেও বন্ধুর মতো মিশেছি। আমার বিয়ের জন্য একসাথে পাত্রী দেখে বেরিয়েছি। জানি না অন্য কারও বড় ভাই এমন সৎ ও ভালো হয় কিনা!’
‘গেল নভেম্বরে মায়ের বাম চোখের অপারেশন হয়েছে। ডান চোখের অপারেশনও করতে তাগাদা দিচ্ছিলেন। হজের আগেই মায়ের ডান চোখও অপারেশন করাবেন- এমন পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু মায়ের সুগার বেশি থাকায় (ডায়াবেটিস) অপারেশন করাননি।’
‘আমি অভিমান করলে ভাই আমাকে বলতেন, আমি নিজের জন্য কিছু করি না। আমার সব ব্যস্ততা মানুষের জন্য। নোয়াখালী থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক আর্মির সার্জন এসেছিলেন গতকাল ভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে। অঝোরে কেঁদেছেন তিনি। স্মৃতিচারণ করলেন, ভাইয়ের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করলেন। এমন অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে আজাদ ভাই’- বলেন ছোট ভাই ইউসুফ হাসান হিমেল।
‘প্রতি ঈদে তিনি সপরিবারে এ বাসায় চলে আসতেন। ভাবী প্রায়ই ভাইয়াকে বলত, জারিফ, জাবির ও জারা বড় হচ্ছে, ওদের জন্য কিছু ভাবনা রেখ। ওদের জন্য কিছু পরিকল্পনা করো। ভাইয়া বলত, আমি আল্লাহর রহমতে মানুষের জন্য কাজ করছি। আমার ব্যস্ততা মানুষের জন্যই। আমার সন্তানদের জন্য আল্লাহ নিশ্চয়ই কিছু করবেন।’
অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ফোন করে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আজাদ ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলেন জেনে নাম্বার নিয়েছি। তার মতো মানুষ হয় না। তার মতো মানুষই পারে এ জামানায় বিনা পয়সায় চাকরি দিতে। আজাদ ভাইয়ের কারণে আমার ছেলে নয়ন আজ সৌদি অ্যাম্বাসিতে চাকরি করছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই তার ভালো করবেন।’
গত ২৫ মার্চ সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকার জঙ্গি আস্তানায় (আতিয়া মহল) পরিচালিত অপারেশন ‘টোয়াইলাইট’-এ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যান র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। ঘটনাস্থলের ৩০০ গজ দূরে জঙ্গিদের রেখে যাওয়া বোমা বিস্ফোরিত হলে স্প্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর আহত হন তিনি। স্প্লিন্টার তার বাম চোখ ভেদ করে মস্তিষ্কে আঘাত হানে।
তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন ২৬ মার্চ উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ২৯ মার্চ দেশে ফেরত এনে পুনরায় তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩১ মার্চ রাত ১২টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লে. কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ১৯৭৫ সালের ৩০ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ৭ জুন ৩৪তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাসদর, প্রশাসনিক শাখা, জাতিসংঘ মিশন ব্যানব্যাট-৫ (আইভরি কোস্ট), ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (সাপোর্ট ব্যাটালিয়ন), র্যাব-১২ এর কোম্পানি অধিনায়ক, এবং র্যাব সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের (টিএফআই সেল) উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর হতে ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।
জেইউ/এমএআর/জেআইএম