পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষ, পৌঁছাচ্ছে না ত্রাণ
টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। যমুনা, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে নদী ভাঙন ও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
তলিয়ে গেছে আমন, আউশ, বীজতলা এবং শাকসবজি ও ফসলের ক্ষেত। বন্যা প্লাবিত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্যের অভাবে পানিবন্দী মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেক পরিবার ঘর ছেড়ে উঁচু মাচা ও কলা গাছের ভেলায় অবস্থান করছে। এখন পর্যন্ত অনেক স্থানে কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি।
দুর্ভোগের পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। এ অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে বানভাসীদের। দুর্গত এলাকা ঘুরে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন:
সিরাজগঞ্জ
উত্তরের জেলা সিরাজগঞ্জের ৬০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। শনিবার যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি না পেলেও জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে যমুনার পানি শনিবার সকালে বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে নদীতে পানি না বাড়লে সিরাজগঞ্জের চলনবিল অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ করতোয়া, হুরাসাগর, গুমানী, বড়াল নদীসহ সব নদ নদীর পানি বেড়েছে। এতে জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
জেলার শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও রায়গঞ্জ উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম নতুন করে বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে জেলার ৮২টি ইউনিয়নের মধ্যে অন্তত ৬০টি ইউনিয়ন কমবেশী এখন বন্যায় আক্রান্ত। বিশেষ করে চৌহালী, কাজিপুর, বেলকুচি এনায়েতপুর, শাহজাদপুর এবং সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চরাঞ্চলের অধিকাংশ ঘর-বাড়িতে পানি প্রবেশ করায় লাখ মানুষের এখন দুর্ভোগের সীমা নেই।
এ সব এলাকার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, ঘরবাড়ি সহ টিউবয়েল ডুবে গেছে। ফলে এসব মানুষেরা এখন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিম কাজিপুর উপজেলায় ও বেলকুচিতে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যেগে শুক্রবার বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অন্য উপজেলাগুলোতে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি বলে বন্যা দুর্গত মানুষেরা অভিযোগ করেছেন।
কুড়িগ্রাম
কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার এক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা কবলিত প্রায় দুই লাখ মানুষ আট দিন ধরে পানিবন্দী জীবন যাপন করছে। দুর্ভোগের পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় চলছে ত্রাণের জন্য হাহাকার।
এ অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে বানভাসীদের। দেখা দিয়েছে গবাদি পশুর খাদ্য সংকট। চরম বিপদে পড়েছে হাতে কাজ ও খাবার না থাকা শ্রমজীবীরা।
কুড়িগ্রামের সদর, চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুর, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, ভুরুঙ্গামারী, রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার ৪০ ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ গত আট দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সীমিত আকারে ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ জানান, বন্যার্তদের জন্য এ পর্যন্ত ২৫০ মেট্রিক টন চাউল ও দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা বিতরণ করা হচ্ছে। আরো বরাদ্ধ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায় গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি তিন সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার এক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ধরলা ও তিস্তার পানি অপরিবর্তিত রয়েছে।
নীলফামারী
জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। অব্যাহত ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি আবারো বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে তিস্তা নদীর উজানে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১৫টি গ্রামের ১৫ সহস্রাধিক মানুষ চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।
ডিমলা উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের আবদুল মোমেন ও রফিকুল ইসলাম নামের দুই কৃষক জানান, সকালের দিকে নদীর পানি কমায় বাড়িঘরের পানি নামলেও দুপুর থেকে আবারও নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গত ৮-৯ দিন ধরে গ্রামের মানুষ কাজকর্ম করতে না পারায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ত্রাণ দেয়ার জন্য ৭৫টি পরিবারের নামের তালিকা করা হলেও পেয়েছে ১৭টি পরিবার।
ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, ঝাড় সিংহেরস্বর ও পূর্ব ছাতনাই গ্রামের দুই সহস্রাধিক মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ৭০০ পরিবারের তালিকা দিয়ে পেয়েছি মাত্র ১০০ পরিবারের জন্য সহায়তা।
গাইবান্ধা
ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তিস্তার পানি ২৪ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র ও করতোয়ার পানি বিপদসীমার কাছাকাছি থাকায় সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সদর উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এসব এলাকায় অর্ধলক্ষাধিক বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মীর আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত চার উপজেলায় এক হাজার ৯২১ হেক্ট জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে রোপা আমন ও আউশ ধান, আমন বীজতলা ও শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সুনামগঞ্জ
টানা বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বেড়েছে সুনামগঞ্জের নদী ও হাওরের পানি। সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় ৮৯মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এছাড়াও জেলার সবকয়টি সীমান্ত নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাহিরপুর,দোয়ারা,শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ
পদ্মায় প্রচণ্ড স্রোত আর বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হয়ে পড়েছে। এখনো ৩ নম্বর ফেরিঘাট বন্ধ রয়েছে। ২ নম্বর ফেরিঘাট দিয়ে রো রো ফেরি চালু করা হয়েছে।
শনিবার সকাল থেকে সারা দিন ফেরিগুলোকে বৈরী আবহাওয়াকে উপেক্ষা করেই চলতে হয়। এতে ফেরিগুলোর গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লাগছে দেড় গুণেরও বেশি।
ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌরুটের উভয় পাড়ে কয়েকশ পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের অপেক্ষায় আটকা পড়েছে।
মাওয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই খালিদ হোসেন জানান, পদ্মায় প্রচণ্ড স্রোতের কারণে এবং আবহাওয়া খারাপ থাকায় ফেরি পারাপারে কিছুটা বিঘ্ন ঘটলেও নিয়মিত ফেরি চলছে।