ভিডিও EN
  1. Home/
  2. জাতীয়

তারেকই আমার শিক্ষক

প্রকাশিত: ০২:৫৫ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০১৪

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তারেক মাসুদ। কীর্তিমান এ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় সূত্র, কর্মজীবন অার অালোচিত ছবিগুলো সম্পর্কে তুলে ধরেছেন তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ

পরিচয়…
তারেক ও আমার পরিচয়টা কীভাবে হলো এটা অনেকেই জানতে চায়। এর মূল কৃতজ্ঞতা আমি দেব সাহিত্যিক আহমদ ছফাকে। আহমেদ ছফার সঙ্গে আমার পরিচয় আগে হয়। সেই  সময় তিনি থাকতেন ইন্দিরা রোডের পরিত্যাক্ত একটি বাড়িতে। বাড়িটা ছিল ডাক্তার মফিজ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাউত্তর বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলের শিল্পমন্ত্রী। আর বাড়িটাকে তখন বলা হতো ‘পাগলা ঘর’। ওই সময় সেই বাড়িতে অনেকেই আসতেন আড্ডা দিতে, আমি গিয়েছিলাম আহমেদ ছফার আমন্ত্রণে। আমার এখনও মনে আছে সেই দিন বৃষ্টি পড়ছিল। মাসটা ছিল জুলাই। যতদূর মনে পরে তারিখটা ছিল ২৯ জুলাই। আমি গিয়েছিলাম আহমেদ ছফার সঙ্গে দেখা করতে সেখানে তারেক ছিল বসে। শর্টফিল্ম এর আরও  অনেকেই ছিল সেদিন। আর সেই  দিন আমি জানতে পারি যে তারেক শিল্পী এসএম সুলতানের উপর একটি  প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছে। সে আমাকে কিছু কাগজও দেয় এই ব্যাপারে। আর যেহেতু সুলতানের সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় আর তার কাজ আমি আগেই দেখেছি। এজন্য আমিও আগ্রহ প্রকাশ করি প্রামাণ্যচিত্রের বিষয়ের উপর। এর পর থেকে প্রায় আমি সেই বাড়িতে যেতাম। তাদের আড্ডার অংশ হতাম, আর তারেকও আমাকে প্রায় ফোন দিত। আর বলত ‘ক্যাথরিন তুমি কি আজ আসছ ?’ এভাবেই তারেকের সঙ্গে আমার পরিচয়। সেই বাড়িটা এখন আর নেই। ওখানে এখন মার্কেট হয়ে গেছে।

আদম সুরতে অংশগ্রহণের শুরু…
‘আদম সুরত’- এর এডিটিং এর কাজ চলছিল সেই সময় ডিএফপিতে। তারেক প্রায় যেত সেখানে। কিন্তু আমাকে নিত না। বলতো জায়গাটা অনেক নোংরা। কিন্তু আমি একদিন জোর করে গেলাম ওর সঙ্গে। এডিটিং রুমে ঢুকে দেখি মানুষের চুলের মতো ফিল্মের টুকরা পড়ে আছে টুলের উপরে, ফ্লোরে। পা ফেলারও জায়গা নেই। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এভাবে কাজ হয়? তারেক আমায় হাসতে হাসতে বলল-  ‘হ্যাঁ এভাবে ফিল্ম কেটে একটার সাথে একটা জোড়া লাগিয়ে কাজ হয়।’ তারপর থেকে আমি প্রতিদিন যেতাম। তারেকই আমার শিক্ষক। বলা যেতে পারে সেই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমার সব প্রশ্নের উত্তর ধৈর্য সহকারে দিত। আর এভাবেই ঢুকে গেলাম ‘আদম সুরত’-এর কাজে। আমাদের সাথে আরও অনেকেই ছিল। এর মধ্যে জুনায়েদ হালিমের নাম বলতে হয়। শেষের দিকে ভারতে আমরা বিভিন্ন কাজে ঘুরলাম। সেখানে অামরা যেমন সাউন্ড মিক্সিং, ল্যাব, ফাইনাল প্রিন্টিং এর কাজ করেছি। একই সাথে দুইটা কাজ হলো। আমাদের সেই সময় ঘোরাঘুরিও হলো সেই সাথে ফিল্মের কাজও হলো। এবং সেই অভিজ্ঞতা  থেকেই আমি ফিল্মের সাথে অনেক বেশি জড়িয়ে যাই। আর তারেকের সঙ্গে  তখন আমারও যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। আলাদা করা যায় না তারেকের সঙ্গে আমার ফিল্ম কিংবা ব্যক্তি সম্পর্ক, কোনওটাই আলাদা করা যায় না।

নিউ ইয়র্কের জীবন শুরুর গল্প…
‘আদম সুরত’ এর কাজ শেষ হবার পরে আমরা আমেরিকাতে চলে যাই। আমাদের বিয়ে আগে হয়ে গেলেও আমার পরিবারের কারোর সাথেই তারেকের তখন পরিচয় নেই। আমরা একসাথে আমেরিকা গেলাম। আমার ভাই, মা-বাবার সাথে তখন তারেকের পরিচয় হল। সেই সময় আমাদের তেমন কোনও পরিকল্পনা ছিল না, আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা নিউ ইয়র্কে থাকি। কয়েকদিন আমাদের প্ল্যান ছিল যে আমরা বছর খানিক নিউ ইয়র্কে থাকব তারপর আমরা বাংলাদেশে চলে আসব। তো সেই সময় আমাদের ফিল্মের কাজ শেষ হয়েছে আমরা তখন আয় রোজগার করার জন্য কিছু করব ভাবছি। তারেক তখন প্রথমবারের মতো চাকরি খুঁজছিল। আমার জন্য বিষয়টা অনেক সহজ ছিল আমি আগেও অনেক কাজ করেছি, কিন্তু তারেকের ব্যাপারে ওখানকার সবাই বলত যে, আপনি ওভার কোয়ালিফাইড। কারণ তারেক শর্টফিল্ম- এর সাথে জড়িত। একটা শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছে। তখন আমি ভাবলাম ওখানে একটা পুরনো বইয়ের দোকান আছে ‘স্ট্র্যান্ড’ নামে, ওই জায়গায় তারেক যদি আবেদন করে তাহলে হয়তো সেইখানে কাজ হয়ে যেতে পারে। কারণ ওখানে অনেক শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতারা কাজ করে আর তারেক তো শিল্প সাহিত্য নিয়ে অনেক জানতো। তো সেখানে একটা পরীক্ষায় তারেক খুব ভালো করার পর তারেকের লাইব্রেরিতে চাকরিটা হয়ে যায়। তো এভাবেই আমাদের নিউ ইয়র্কের জীবন শুরু হয়।

মুক্তির গানের শুরু…
নিউ ইয়র্কে থাকা অবস্থায় একদিন হঠাৎ আমরা খবর পাই লিয়ার লেভিন নামে এক মার্কিন চিত্রগ্রাহক-পরিচালকের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক মুল্যবান দলিল আছে। এরপর তার সঙ্গে ফোনে বেশ কয়েকবার কথা হবার পর, অবশেষে আমরা দেখা করতে পারলাম। আমরা তার কাছে জানতে পারি, তিনি প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো শ্যুটিং করলেও তিনি তার ছবিটির কাজ শেষ করতে পারেননি। এরপর তিনি তার বাড়ির বেইজমেন্ট থেকে কিছু ফুটেজ এনে দেখানোর পর আমরা উদ্বুদ্ধ হয়ে গেলাম। তার তোলা ছবিগুলো ছিল অসাধারণ রঙ্গিন এবং সেই সময়ে করা লাইভ সাউন্ডের কাজ। আমরা এগুলো দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এগুলো নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। এরপরই আমাদের চাকরি জীবনের অবসান। এবং দীর্ঘ চার বছর ধরে চলল মুক্তির গানের কাজ। এরপর কাজ শেষে ‘মুক্তির গান’- এর ৪টা প্রিন্টসহ আমরা নিউ ইয়র্ক থেকে চলে এলাম বাংলাদেশে। আমরা ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এরপর কোনওরকম আর্থিক সামর্থ্য ছাড়া নিজেরাই ছবিটি ১৯৯৫ সালের ৪ ডিসেম্বর শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে প্রথম প্রদর্শনের ব্যবস্থা করি। প্রথম প্রদর্শনীতে দর্শক ছিলেন ২০ জনের মতো। কিন্তু তারেক ছিল আশাবাদী। সে বলছিল, দেখো এই মানুষগুলোর কীভাবে ছবিটা দেখছে। আমি ছবিটা নিয়ে আশাবাদী। তো এভাবেই শুরু ‘মুক্তির গান’-এর গল্প।

মাটির ময়নার চিত্রনাট্য…
তারেকের খুবই ইচ্ছা ছিল যে তার ছোটবেলার গল্প নিয়ে কাজ করার। আমিও সবসময় উৎসাহ দিতাম এ বিষয়ে কাজ করার জন্য। কিন্তু সেটা নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র করা সম্ভব ছিল না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নেই চলচ্চিত্র করার। এর জন্য চিত্রনাট্যের কাজে আমরা চলে যাই তারেকের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নূরপুরে। সেখানে গিয়ে আমরা চিত্রনাট্যের কাজ করতে গেলে শুরু হয় বৃষ্টি এবং বন্যা। হাইওয়ে চলে গেল পানির নীচে। এজন্য আমাদের আটকে থাকতে হল প্রায় ১৫ দিন। এভাবে থাকতে থাকতে আমরা তারেকের ছোটবেলার স্মৃতিময় ঘটনা গুলো সেই জায়গা এবং চিত্রায়নের জায়গায় বসেই মোটামুটি চিত্রনাট্যের বেশ বড় একটা অংশের কাজ শেষ করলাম। তারেক মূলত সংলাপ ও গল্প গঠন এবং আমি চিত্রায়ণের দিক গুলোর কাজ একে একে করতে থাকলাম।

অনুলিখন: অাফতাব হোসেন