ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : ইতিহাসের এক অনন্য দিন
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ শনিবার। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য দিন। সুদীর্ঘকালের আপসহীন আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ওই দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। ওই দিন লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের এক উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের মহান কবি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম..., এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার চূড়ান্ত দিক-নির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রনিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে।
ধর্মীয় চিন্তা, সাম্প্রদায়িকতার মানসিকতা ও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয় তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্যদিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে গর্জে ওঠে উত্তাল জনসমুদ্র। লাখ লাখ মানুষের গগনবিদারী শ্লোগানের উদ্দামতায় বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সেদিন পত্ পত্ করে ওড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খঁচিত লাল-সবুজের পতাকা। লক্ষ শপথের বজ্রমুষ্টি উত্থিত হয় আকাশে।
সে দিন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুণের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখ লাখ বাঙালির ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব ’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
তিনি দরাজ গলায় তাঁর ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’
মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণ। এই স্বল্প সময়ে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। তিনি তার ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকান্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।’
সে দিন তিনি ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারি অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ।’
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দু’টি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।
বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটি প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- শনিবার ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। বিকেল ৩টায় ৭ মার্চের ভাষণের স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে জনসভা। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন।
দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার এবং জাতীয় পত্রিকাসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।
আরএস