সারারাত নির্ঘুম কল্যাণপুর
যদিও আগাম তথ্যও ছিল না পুলিশের কাছে। তবে ব্লক রেইড দিতে গিয়ে জঙ্গি আস্তানার আবিষ্কার করে পুলিশ। রাত সাড়ে ১২টায় কল্যাণপুরের ৫ নং সড়কের ৫৩ নং বাড়ি জাহাজ বিল্ডিং এর পঞ্চম তলায় পুলিশের চার্জ। রাত পৌনে ১টার দিকে ভেতর থেকে গুলি করা হয়। এরপর পুলিশ-জঙ্গিদের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি। সকাল ৫টা ৫১ মিনিটে অপারেশন স্টোর্ম-২৬। পুরো কল্যাণপুরবাসী ছিল নির্ঘুম। বিশেষ করে আশপাশ এলাকার মানুষ ছিল আতঙ্কগ্রস্ত।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পুরো রাতটি জীবনের একটি কালো অধ্যায়। নিচে নামতে পারছিলেন না কেউ। গুলির শব্দে শিশু-কিশোরদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল বেশিই। সন্তানদের সান্ত্বনা দিতে আতঙ্কগ্রস্ত বাবা-মা কিংবা অভিভাবকরাও ছিলেন পুরো রাত জেগে।
স্থানীয় বাসিন্দারা আরো জানান, রাত তখন আনুমানিক সাড়ে ১১টা। তখনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী সচেতনতামূলক প্রচারণা চলছিল মেসে ও বাসা বাড়িতে। পাশেই আবার মিরপুর থানা পুলিশে চলছিল ‘ব্লক রেইড’। ১১, ৩ ও ৪ নং রাস্তায় অভিযান শেষে সাড়ে ১২টার দিকে ৫ রোডের ৫৩ নং বাসার পঞ্চম তলায় গিয়ে বিপত্তি। দরজায় লাথি দিলেও কেউ খুলছিল না দরজা। এরপর পুলিশ চার্জ করলে পৌনে ১টার দিকে ভেতর থেকে গুলি করা হয়।
চা দোকানদার নুরুল ইসলাম বলছিলেন, “আমার দোকান চলে মধ্যরাত অবধি। গতকাল সাড়ে ১২টার পরপরেই পুলিশ আইসা উইঠা দিয়ে গেছে গ্যা। পরে বাসায় ফিইরা হুনি গুলির আওয়োজ। ভয়ে জড়োসড়ো। সারাটা রাত না ঘুমায় কাটাইছি।”
৬২ নং বাসার ভাড়াটিয়া বাসিন্দা ফজলুর রহমান জানান, আল্লাহু আকবার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। আবার বাইরে ও ভেতর থেকে মনে হচ্ছিল দুই পক্ষের গোলাগুলি। এভাবে সারাটা রাত থেমে থেমে গোলাগুলি। ভোর রাতে তো মনে হচ্ছিল যুদ্ধ শুরু হইছে। ভয়ে স্ত্রী সন্তানরে লইয়া খাটের নিচে ছুইয়া পড়ছি।
ওই জাহাজ বিল্ডিংয়ের ষষ্ঠ তলার মেসের বাসিন্দা কামরুলের বড় ভাই মিরপুর কলেজের প্রভাষক কাইয়ুম জানান, ছোট ভাই মধ্যরাতে ফোন করে জানায়, এখানে গোলাগুলি, আমাকে বাঁচান। সেই খবরে সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। সকালে আইসা এমপির সঙ্গে দেখা করছি। কাম হয় নাই। দুপুর ১২টা অবধি ছোট ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হইছে। এরপর ফোন বন্ধ। পরে শুনি পুলিশ ৪২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছে।
জাহাজ বিল্ডিংয়ের ঠিক পাশের ৫৩/১ বাসার তৃতীয় তলার বাসিন্দা শুভঙ্কর মজুমদার। পেশায় তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পর ওই বাসায় গেলে মিরপুরের লোডস্টের ফ্যাশন লি. এর এ ইঞ্জিনিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, রাত ১টার দিকে গুলির শব্দ। রাত দেড়টার দিকে দুজন পুলিশ সদস্যকে জানালা দিয়ে নিচে দেখি পাশের বিল্ডিং তাক করে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। মাঝে মধ্যে টর্চ লাইটে আলো দিয়ে দেখতেছে। আমাদের বলা হলো বাসার ভেতরে যেতে।
এরপর থেমে থেমে গোলাগুলি। ভোর রাতে মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো গার্লস স্কুলের দিকের কোনো ঘটনা। যখন নিশ্চিত হই পাশেই তখন ভয়ে আমার খুবই খারাপ অবস্থা। খুবই ভয়-আর আতঙ্কের মধ্যে সারাটা রাত পার করেছি। বিকেল ৫টা অবধি থেকে বের হতে পারিনি।
এভাবেই কল্যাণপুরের কয়েক লাখ মানুষের রাত কেটেছে আতঙ্কে। ভোর রাত থেকে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ফোনে ঘটনাস্থলে আসেন সকালেই। তবে পুলিশের পরামর্শে ও পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেয়া হয়।
কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে দক্ষিণ পাইকপাড়া, মধ্য পাইকপাড়া, নতুন বাজারসহ বিভিন্ন রুটে যাওয়ার সব রাস্তা রাতেই বন্ধ করে দেয়া হয়। যান চলাচল না হওয়ায় কল্যাণপুরে নিজ বাসায় ফেরত অনেক মানুষকে রাত কাটাতে হয় বাসস্ট্যান্ডেই।
অবশেষে সকাল ৫টা ৫১ মিনিট থেকে ৬টা ৫১ মিনিট পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের সোয়াট টিম এবং বোমা ডিসপোজাল ইউনিট এবং ডিবি পুলিশ অপারেশন স্টোর্ম-২৬ চালায়। ঘণ্টাব্যাপি সমন্বিত চেষ্টায় কল্যাণপুরের অভিযান শেষ হয়। নিহত হয় ৯ সন্দেহভাজন জেএমবি সদস্য। হাসান নামে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। তার মাধ্যমে উঠে আসে নিহতদের নাম।
জেইউ/বিএ