জানালা দিয়ে দেখি অনেক পুলিশ...
মুহুর্মুহু গুলির শব্দ। আমরা কেউ রান্না ঘরে। কেউ তোষক বালিশ আর কাথা কম্বল পেচিয়ে যে যেভাবে পেরেছি শুয়ে পড়েছি। মনে হচ্ছিল আমাদের জিম্মি করা হচ্ছে। হয়তো অন্য দেশের মানুষের মতো আমরাও এখানে জঙ্গিদের হাতে মারা যাচ্ছি।
এভাবেই ভীতিকর অবস্থার কথা বর্ণনা করেন কল্যাণপুরের ওই জঙ্গি আস্তানার উপরের মেসের বাসিন্দা আশিক। একই বিল্ডিংয়ে ছয় তলায় থাকেন তারা ৯ জন। তাদের মধ্যে সাতজন রাতে বাসায় ছিলেন। বাকি দুজন বাসার বাইরে ছিলেন। শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র আশিক।
তিনি বলেন, রাত পৌনে ১টার দিকে পরপর তিনটি গুলির শব্দ শুনে আমার ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠে দেখি সবাই ছুটোছুটি করছে। বলছে বাইরে গোলাগুলির শব্দ। এরপর নিচ থেকে কারা যেন স্লোগান দিচ্ছিল ‘আল্লাহ আকবার’।
জানালা দিয়ে দেখতে পাই অনেক পুলিশ। সবাই অস্ত্র নিয়ে ঘিরে আছে পুরো বাড়ি। তখন মনে হলো যারা স্লোগান দিয়েছে তারা হয়তো কোনো সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি। এরপর আমরা সবাই গুলি থেকে বাঁচার জন্য দরজার পাশে, রান্না ঘরে, কেউ কাঁথা বালিশ তোষক মুড়িয়ে শুয়ে পড়ি। এরপর ভোরে শুরু হয় গোলাগুলির শব্দ। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে মনে হচ্ছিল আমরাও মরে যাচ্ছি।
ঢাকার কল্যাণপুরে যে জঙ্গি আস্তানায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়েছে, সেই ভবনের এ মেস বাসিন্দার মতো একই ভীতিজনক অবস্থার কথা উঠে আসে আল্লামা ইকবাল অনিকের মুখে। তিনি জাগো নিউজকে মুঠোফোনে জানান, গোলাগুলির মধ্যে সারা রাতের আতঙ্কের চিত্র।
স্থানীয়রা জানান, কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের গার্লস হাই স্কুলের পাশে ৫৩ নম্বর বাড়ির গায়ে ‘তাজ মঞ্জিল’ নাম লেখা থাকলেও স্থানীয়রা ছয় তলা ওই ভবনকে চেনেন ‘জাহাজ বিল্ডিং’ নামে।
পুলিশ জানায়, বাড়িওয়ালা থাকেন বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। প্রতিটি তলায় রয়েছে চারটি করে ফ্ল্যাট। উপরের কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে ব্যাচেলরা মেস করে থাকে, যার সুযোগে পঞ্চম তলায় গড়ে উঠেছিল জঙ্গি আস্তানা।
আল্লামা ইকবাল অনিক নামে ওই ছাত্র একটি অনলাইন পত্রিকায় কাজও করেছেন কিছুদিন। ঢাকার ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করা অনিকের দেশের বাড়ি কুড়িগ্রামে। ওই বাসায় তিনি আছেন গত পাঁচ বছর ধরে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাসার আশপাশে পুলিশের উপস্থিতি তারা টের পান। পরে বুঝতে পারেন, তাদের ভবনেই অভিযান শুরু হয়েছে।
ঘণ্টা দেড়েক পর পুলিশ উপরে ওঠার চেষ্টা করলে শুরু হয় গোলাগুলি। অনিক ও তার সঙ্গে থাকা তরুণদের সবাই আতঙ্কে বাসার দরজা ভেতর থেকে আটকে রান্না ঘরে গিয়ে অবস্থান নেন।
‘সারাটা রাত আমরা রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলাম। একটু পর পর গুলির শব্দ। খুব ভয় হচ্ছিল। গুলির শব্দে মনে হচ্ছিল মরে যাচ্ছি, আর বুঝি বাঁচব না। তখন মা-বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল মা-বাবার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসে বুঝি লাশ হয়ে ফিরবো।’
মধ্য রাতে অনিকের মোবাইল ফোন থেকে আসা কল ও এসএমএস পাওয়ার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় যায় যে সেখানে জঙ্গি হামলার বিষয়।
পুলিশ জানিয়েছে, পঞ্চম তলার সাতটি কক্ষ সন্দেহভাজন ওই জঙ্গিরা ভাড়া নিয়েছিল। নিহতদের মধ্যে সাতজনের লাশ পাওয়া গেছে করিডোরে, দুজনের লাশ ছিল দুটি কক্ষে।
ঘণ্টাব্যাপী অপারেশন স্ট্রম-২৬ শেষে ঘটনাস্থল থেকে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, অভিযানের সময় জঙ্গিরা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গুলি করতে করতে পালানোর চেষ্টা করে। তাদের পরনে কালো রঙের জঙ্গি পোশাক ছিল, মাথায় ছিল পাগড়ি, হাতে ছিল ব্যাগ।
গুলশানে ‘জেএমবির যে গ্রুপটি’ হামলা চালিয়েছিল, এরা সে দলেরই সদস্য বলে আইজিপি শহীদুল হকের ধারণা। তাদের আইএস বলা হলেও আসলে তারা আইএস নয়; তারা জেএমবির সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযান ক্রাইম সিন উদ্ধার ও তদন্ত পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানানো যাবে।
উল্লেখ্য, কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অপারেশন স্ট্রম-২৬ এর বিস্তারিত তথ্য জানাতে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
জেইউ/জেএইচ/পিআর /এমএফ