‘রিকশা ট্র্যাপার’ যেন নিজেই ‘ট্র্যাপে’!

রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা-অটোরিকশা প্রবেশ রুখতে বিভিন্ন সময়ে নানান পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে বারবার। প্রধান সড়কে রিকশা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চোর-পুলিশ খেলায় মেতে ওঠেন রিকশাচালকরা। নানান আন্দোলন শেষে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় প্রধান সড়কগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। রিকশা-অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশকে।
এ অবস্থায় ঢাকার যেসব সড়কে রিকশা চলাচল নিষেধ, সেগুলোর প্রবেশমুখে ‘ট্র্যাপার’ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে ডিএমপি। আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে রমনা পুরোনো থানার সামনে এবং তারই ঠিক বিপরীত পাশে ইস্কাটন গার্ডেন সড়কের মুখে ট্র্যাপার বসানো হয়েছে। কার্যকরী মনে হলে পরে বসানো হবে শহরের অন্যান্য সড়কেও। এই ট্র্যাপার পেরিয়ে প্রধান সড়কে যেতে চাইলে লোহার খাঁজে রিকশার চাকা আটকে যাবে- সেই পরিকল্পনা থেকেই ডিএমপির এই উদ্যোগ।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
তবে ট্র্যাপার বসানো হলেও হরহামেশাই তা অতিক্রম করে রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। ফলে এই প্রকল্প কতটা আলোর মুখ দেখবে সেই প্রশ্ন জনমনে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
এদিকে খোদ রিকশা চালকরাই প্রশ্ন তুলছেন এই প্রকল্প নিয়ে। তাদের ভাষ্য, পূর্বেও এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো কাজে লাগেনি।
ভিন্ন মত দিচ্ছেন নগর-পরিকল্পনাবিদরাও। তারা বলছেন, পুরো শহরে রিকশার বাস্তবসম্মত গাইডলাইন তৈরি করা না হলে অতীতের অনেক উদ্যোগের মতোই এটাও বিফলে যাবে।
বিজ্ঞাপন
- আরও পড়ুন
- সড়কে রিকশা নিয়ন্ত্রণে ‘ট্র্যাপার’ বসালো ডিএমপি
- ব্যাটারি চালিত রিকশায় চালকের যত সুবিধা-অসুবিধা
- অটোরিকশা শ্রমিকদের শৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালানোর আহ্বান
রোববার (২৩ মার্চ) ট্র্যাপার বসানোর দুটি স্থানে সরেজমিনে দেখা যায়, এসব সড়কে হরহামেশাই চলাচল করছে রিকশা-অটোরিকশা। মাঝেমধ্যে ২-১টি রিকশার চাকা এই ফাঁদে আটকালেও অধিকাংশ রিকশাই চালকের বুদ্ধিমত্তায় পেরিয়ে যাচ্ছে এই বাধা। কেউ কেউ আবার এই ফাঁদ দেখে ঘুরিয়ে নিচ্ছেন রিকশা। কেউবা আবার রিকশা উঁচু করে পারি দিচ্ছেন সড়ক বিভাজক। আবার কাউকে ট্র্যাপারে চাকা আটকানোর ভয়ে ফাঁদের ওপর দিয়ে একটু আড়াআড়ি বা বাঁকাভাবে অতিক্রম করতে দেখা গেছে। ফলে ট্র্যাপারের ফাঁদে না পরে নির্বিঘ্নে পারি দিচ্ছে রিকশা। এছাড়াও সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে ট্র্যাপার বসানোর ফলে দুই পাশের খালি স্থান দিয়েও সহজেই পারি দিচ্ছে এসব রিকশা।
রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা রিকশাচালক মো. কালাম বলেন, ‘এর আগে একবার দেখেছিলাম বিভিন্ন জায়গায় করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাটির তলে গেছেগা। ফার্মগেট দেখছি, বিভিন্ন জায়গা এ রকম দিছিল। এর মধ্যে চাকা পড়ে যেত। কিছুদিন পর যখন রাস্তা একবার ঢালাই দিলো, ওই মাটির তলে পড়ে গেছেগা। কোনো কাজে লাগে নেই।’
বিজ্ঞাপন
রিকশাচালক সুমন বলেন, ‘আগে তো এই রাস্তা দিয়ে কোনো রিকশা-ভ্যান কিছুই ওঠেনি। মাঝেমধ্যে দু-একটা গাড়ি (রিকশা-ভ্যান) যেতো। এখন সব যায়। আর আমি যদি আগে যানতাম রাস্তা এখানে এভাবে করেছে (ট্র্যাপার) তাহলে এই পথে আসতাম না। অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতাম।’
বেইলি রোডের স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুজ্জামান বলেন, ‘এভাবে রিকশা চলাচল ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দেখতেই তো পারছেন, এর ওপর দিয়েই রিকশা যাতায়াত করছে। মাঝেমধ্যে দু-একটা আটকে যাচ্ছে, আবার চাকা বের করে নিয়ে চলে যাচ্ছে। দুদিন পর দেখা যাবে টোকাইরা এই লোহার খাঁচাসহ চুরি করে নিয়ে চলে গেছে।’
এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘অটোরিকশা বা সাধারণ রিকশাগুলো একটা বড় শহরে কোথায় চলবে না চলবে তার পরিকল্পনা থাকে। যে কোনো বড় শহরের একটা পরিকল্পনা থাকে, সেটা সামাজিক বাস্তবতা মাথায় রেখেই করতে হবে। এটা আবার পুরোটা রিকশামুক্ত সিটির আদলেও হবে না। ঢাকা শহরে রিকশা কিছু রাস্তায় চলতে পারবে, কিছু রাস্তায় চলতে পারবে না, এইটা একটা কমিউনিটি বেইজ এলাকা ভিত্তিক মবিলিটি চেইন প্ল্যানিং থাকা দরকার। এই প্ল্যানিং না করে হঠাৎ হঠাৎ রাস্তা বন্ধ করতে এমন প্ল্যান করলে হবে না।’
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের ফুটপাতে মোটরসাইকেল যেন না চলাচল করতে পারে সেজন্য ‘ভার্টিকেল পোল’ দেওয়া হয়েছিল। এতে কি ঢাকা শহরের ফুটপাতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করা গেছে? ফলে আমাদের সাধারণ মানুষেরও ফুটপাতে হাঁটতে কষ্ট হয়। যারা হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন তারাও কিন্তু এই পোলে আটকে যান।’
- আরও পড়ুন
- সড়কে বেপরোয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ঘটছে দুর্ঘটনাও
- নীতিমালা ছাড়া সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা নামলে বিশৃঙ্খলা বাড়বে
- ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করতে দেওয়া যাবে না
ড. আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, ‘রিকশা নিয়ন্ত্রণে প্ল্যানগুলো না করা যে কোথায় কোন রাস্তায় রিকশা চলতে পারবে বা নজরদারি না করা, এগুলো এনফোর্সমেন্ট কমিউনিটি এনগেজমেন্ট প্ল্যানিং। এগুলো বাস্তয়ন না করে রিকশা চলাচল বন্ধ করার জন্য এটা করবেন ওটা করবেন- এগুলো আসলে প্ল্যানিংয়ের অংশ না। ঢাকা শহরে পরিকল্পনা নেই বলে এমন অবস্থা। রাষ্ট্রও বলতে পারবে না যে রিকশা চলাচলে কোথাও কোনো প্ল্যান আছে কি না। হাইকোর্ট কখনো বলে একদম চলতে পারবে না, আবার কখনো বলে চলবে।’
তিনি বলেন, ‘এভাবে মেগাসিটি চলে না। মেগাসিটি চলতে গেলে ঢাকার বাস্তবতায় রিকশার গুরুত্ব আছে। রিকশাগুলো কোথায় চলতে দেবো, কোথায় চলতে দেবো না, তারা কোথায় পার্কিং করবে, অপরাধ করলে পেনাল্টি কী হবে, রিকশা মালিক যারা রিকশাগুলো অপারেট করেন তাদের সঙ্গে বসা এবং সব মিলিয়ে একটা পরিকল্পনা দরকার। পুরো শহরে রিকশার গাইডলাইন তৈরি করা এবং সেটা যেন বাস্তবসম্মত হয়। এগুলো করলেই সমাধান হবে অথবা অতীতের অনেক উদ্যোগের মতোই এটাও বিফলে যাবে।’
বিজ্ঞাপন
এই ধরনের ট্র্যাপার রিকশা নিয়ন্ত্রণে কতটা কার্যকর? জানতে চাইলে ওই এলাকায় দ্বায়িত্বরত রমনা ট্রাফিক বিভাগের এএসআই (নিরস্ত্র) আব্দুল মালেক বলেন, ‘এটা পরীক্ষামূলক বসানো হয়েছে।’
এখান দিয়ে হরহামেশাই রিকশা যাতায়াত করছে। আপনার কি মনে হয় এটা আরও আপডেট করা প্রয়োজন? জবাবে তিনি বলেন, ‘রিকশাচালকেরা সাধারণ শ্রমিক। তারা খেটে-খেয়ে বাঁচতে চান। কিন্তু এখানে আমাদের সাধারণ যাত্রী যারা আছেন তারা অনেক হায়ার এডুকেটেড (উচ্চ শিক্ষিত), তাদের অনুপ্রেরণায় রিকশাচালকরা এর ওপর দিয়ে রিকশা চালিয়ে দেন। সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে যেন রিকশাচালকরা এই ট্র্যাপার পেরিয়ে যেতে প্রলুব্ধ না হন।’
বিজ্ঞাপন
এদিকে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মোস্তাফিজুর রহমান শনিবার (২২ মার্চ) গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঢাকার সড়কে রিকশা চলাচল সীমিত করার অংশ হিসেবে ট্র্যাপার বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হচ্ছে। কতটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় সেটা দেখা হবে। এটা এখনো চুড়ান্ত হয়নি।’
ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ট্রাফিক অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ) মেহেদী হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যেসব সড়কে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ, ওইসব সড়কে পর্যায়ক্রমে আমরা এগুলো চালু করবো।’
তিনি বলেন, ‘এগুলো একসময় ঢাকায় ছিল বলে শুনেছি। এগুলো স্থাপনের পর যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। আমরা সেটাও করবো।’
কেআর/ইএ/জিকেএস
বিজ্ঞাপন