ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বর্তমান বাস্তবতায় নতুন রাজনৈতিক দল

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ০৯:৩০ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরেই এই পর্যন্ত আবর্তিত হয়ে আসছে। এই দুই প্লাটফর্মের বাইরে নতুন কোনো রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হোক এমনটা বহুবছর ধরেই মানুষের আকাঙ্ক্ষা। জন আকাঙ্ক্ষা পূরণে কিছু উদ্যোগ নিতেও দেখা গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে-বিগত ৫৩বছরে দুই দলেই ঘোরপাক খাচ্ছে রাজনীতি। জাতীয় পার্টি কিংবা জামায়াতে ইসলামির অবস্থান লক্ষণীয় হওয়ার পরও কিংবা আরও অনেক দলের সৃষ্টি হলেও কেউই এই দুই শক্তির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে,‘আমরা আর তোমরা’-এই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতির মালিকানা।

বৈচিত্র্য এবং প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরির একটা ইতিবাচক সুযোগ তৈরি হয়েছে গত জুলাই- আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীকালে। যা এমন অভ্যুত্থানের পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায়-বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে গোটা আন্দোলনই পরিচালিত হয়েছে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে থেকে এবং পরিচালকদের মধ্যে একক কোনো নেতৃত্ব ছিল না। শুধু তাই নয়,তাদের সাংগঠনিক ও ব্যক্তি পরিচয়ও জাতীয়ভাবে তেমন একটা ছিল না। এই আন্দোলনকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়,বাংলাদেশে নতুন একটা রাজনৈতিক পরিবেশের সূচনা হয়েছে। আন্দোলনের সাফল্যের পরপরই বোঝা গিয়েছিল,নতুন কিছু একটা প্ল্যাটফরম হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে।

সেই আলোকেই- এই সূচনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া কতটা সম্ভব হবে কিংবা নতুন আঙ্গিকে কোনো রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হলেও তারা কতটা সফল হবে,এমন পর্যালোচনা হতেই পারে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের দেওয়া ভাষ্যমতে- তারা শিগগিরই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছেন। আরও খতিয়ে দেখলে তাদের এই উদ্যোগ যে ইতোমধ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, তাও প্রতীয়মান হয়। সম্ভবত ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন দলের ঘোষণা করতে যাচ্ছে, নবীন রাজনীতিবিদগণ। তাদের দ্বারা গঠিত নাগরিক কমিটি সেই কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে নাগরিক কমিটিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে দেখা যায়।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরের উদ্যোগগুলোর সঙ্গে তাদের উদ্যোগের তুলনা করলে কিছুটা ব্যতিক্রম চোখে পড়ে। বিএনপি সৃষ্টিকালে নতুন দল করার মতো ক্ষেত্র ছিল বিশাল। স্বাধীনতা বিরোধীরা তখন ছিল রাজনীতির বাইরে। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ ছিল না। ফলে মুসলিম লীগ,পিডিপি ও নেজামে ইসলামীর মতো দলের কর্মীদের পাওয়া সহজ হয়েছিলো।অন্যদিকে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত বিশাল রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের নেতাকর্মীদের মধ্যেও হতাশা ও নেতৃত্বের কোন্দল ছিল প্রকাশ্যে। আওয়ামী লীগেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শূন্যস্থান পূরণ করার মতো ওই মাপের নেতা ছিল না।

মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপও ছিল অনেকটা ছত্রভঙ্গ। প্রবীণ এই নেতার অনুসারী মশিউর রহমান জাদু মিয়ার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নেতাদের বড় একটা দেয়াল তৈরি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে। কারণ জাদু মিয়া মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা করে তাদের থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। ফলে ভাসানী ন্যাপেরও বড় একটি অংশকে জিয়াউর রহমান কাছে টানতে পেরেছিলেন।

আর বিভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে মিশ্রধারার দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তাকে সহযোগিতা করেছিল ক্ষমতায় থাকাটা।তিনি ক্ষমতার সুযোগটি গ্রহণ করেছেন।দেশে সব রাজনীতি বন্ধ করে দিয়ে তিনি নিজে সরকারি কাজের উছিলায় চষে বেরিয়েছেন আর দল সংগঠিত করার কাজ করেছেন।যে মুহূর্তে তিনি ঘরোয়া রাজনীতি চালু করলেন, তার আগেই তাঁর দলীয় সংগঠন মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে।

পরবর্তীকালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পরও তার পূর্বসূরী জিয়াউর রহমানের পথ-পন্থা অনুসরণ করলেন। তাঁর সময় রাজনীতির মাঠ আগের মতো এতটা খোলা ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মাঠে ছিল। তিনি সামরিক শাসন মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করলেও দুটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেননি কিংবা পারেননি। তাকেও চলমান দল থেকে নেতা-কর্মীদের এনে দল গঠন করতে হয়েছে।

ক্ষমতায় থেকে দল গঠনের সুবিধা তিনিও নিয়েছেন। জিয়াউর রহমানের মতোই মিশ্র আদর্শের একটি দল তিনিও গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো শক্তিশালী প্ল্যাটফরম গঠন করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। তারপরও বলতে হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এমন অবস্থায় বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিএনপি দুই ধারার রাজনীতির বাইরে তৃতীয় একটি রাজনৈতিক শক্তির বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। আর এই সম্ভাবনা আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকারীদের কেন্দ্র করেই যে হতে পারে তা বলাবাহুল্য।বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির উদ্যোগে সেই চেষ্টা চলছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির দল গঠনকালীন অবস্থা আর তাদের অবস্থা অনেকাংশে একইরকম।

উল্লিখিত দুটি দল যেমন ক্ষমতায় থেকে জন্ম নিয়েছে,বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরও গঠিতব্য দলটিও একই সুবিধা অর্জন করছে। কারণ বৈষম্য বিরোধীদের সমর্থিত সরকার এখন ক্ষমতায়। তাদের প্রতিনিধিও সরকারে আছে। তাই এক অর্থে তাদের ক্ষমতাসীন বলা যায়।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি দল গঠনকালে জিয়াউর রহমানের মতো খোলা মাঠ পাচ্ছে না। তাদের ঘোষণা তারা রাজনীতিতে নতুনধারা যুক্ত করতে চায়। এই পর্যন্ত তাদের দেখা গেছে শিক্ষার্থী ও তরুণদের দিকে অধিকতর মনোযোগী হতে। ধরে নেয়া যায়,নতুনদের প্রাধান্য দিয়েই হয়ত দল গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।সহজেই অনুমান করা যায়,তাদের এই চিন্তার পেছনে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তরুণদের অর্জনের উদাহরণ আছে। সেই অনুযায়ী তারা নাগরিক কমিটি গঠন করেছে নতুনদের নিয়ে। নতুন দলেও এই নাগরিক কমিটির অনেকেই থাকবেন সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে। কেন্দ্রের বাইরে নাগরিক কমিটির সদস্য কিংবা সমর্থকদের বিষয়টি বাদ দিলে তাদের নতুন সদস্য পাওয়ার বিষয়টি আসে। তারা যদি গত অভ্যুত্থানের কর্মীদের লক্ষ্য করে থাকে,তখন দেখতে হবে অভ্যুত্থানে সব দল ও মতের মানুষ অংশ নিয়েছিলো।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা নিজ নিজ ঠিকানায় ফিরে গেছেন। এখন নতুন কেউ যদি তাদের দলভুক্ত করতে চায় সেটা সহজ হবে বলে মনে হয় না। যেমনি বিএনপি জামায়াত থেকেও পাবে খুবই সামান্য। আওয়ামী লীগ থেকে বড় একটি অংশ তারা নিতে পারতো। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে কিছু নেতা-কর্মী নতুন দলে যোগ দিত সন্দেহ নেই। এমন একটি আভাসও পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনে শরিক দলগুলো হুশিয়ার করে দিয়েছে তাদের। ফলে আওয়ামী লীগ থেকে কোনো লোক নতুন দলটিতে ঢুকতে পারছে না কিংবা তারাও আওয়ামী লীগ থেকে কাউকে গ্রহণ করবে না। তাহলে অর্থ দাঁড়ালো যে,গঠিতব্য দলটিতে তারুণ্যেরই আধিক্য থাকছে। হয়ত কিছু প্রবীণও থাকতে পারেন।

যেহেতু আওয়ামী লীগের কেউ সুযোগ পাচ্ছে না তাই প্রথম সুযোগ তৈরি হবে বিএনপির পদবঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের জন্য। গঠিতব্য দলটিও ক্ষুদ্র দলগুলোর বড় নেতার চেয়ে বিএনপির ছোট নেতাকেই প্রাধান্য দেবে কৌশলগত কারণে। ফলে নতুন কোনো দল গঠন হলে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির সাংগঠনিক ক্ষতি হতে পারে বেশি।

বিএনপির ভিতরে এমন একটা ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে আছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত দলের কাউন্সিল অধিবেশন না হওয়ার কারণে নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে না। জেল-নির্যাতন ভোগ করার পরও তাদের প্রাপ্তি নাই। কারণ প্রায় দুই দশককাল ধরে তারা ক্ষমতার বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন সুযোগ এলে হাতছাড়া করবে বলে মনে হয় না।

একটা উদাহরণ দেওয়া যায়- জিয়াউর রহমান দল গঠনকালে আওয়ামী লীগের থানা পর্যায়ের নেতাদেরও জাতীয় পর্যায়ে টেনে আনার উদাহরণ আছে। ফেঞ্চুগঞ্জ থানার আওয়ামী লীগ নেতা ইস্কান্দর আলীকে করা হয়েছিল জাতীয় শ্রমিক দলের প্রধান। এমন অনেকেই সুযোগ পেয়েছিলেন। এবারও যদি বিএনপির এমন স্থানীয় নেতাও নতুন দলের কেন্দ্রে চলে আসে তাও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ নতুন দলে যাবে এমন মনে হয় না। তবে বিভক্ত জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ দাওয়াত পেলে যে খাবেনই তা বলা যায়। কারণ দলটি এখন বিভক্ত হয়েছে আরেক দফা। এমন হলে জাতীয় পার্টি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হয়ে পড়বে তা বলা যায়। গঠিতব্য দলটি আওয়ামী লীগের বাইরে নিজেদের প্রথম দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থানে দাঁড় করাতে সক্ষম হবে তাই দেখার বিষয়।

গঠিতব্য দলটির আদর্শ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেনি উদ্যোক্তারা। তবে অনুমান করা যায়-ধর্মীয় উগ্রবাদকে তারা প্রশ্রয় দেবেন না। ভারত বিরোধী জোয়ারকে কাজে লাগানোর শতভাগ চেষ্টা থাকবে তাও বোঝা যায়। ভারত বিরোধিতাকারী একাধিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে আছে। সুতরাং শুধু এই শর্তটি নতুন দলকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে অনুমান করা কঠিন। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হবে নবীনদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণে।

রাজনীতিতে অ আ ক খ শেখা উদ্যমী নবীনরা সংগঠনকে চাঙ্গা করতে সক্ষম হলেও তাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে। আবার নতুন কোনো দিকনির্দেশনা যদি তারা উপস্থাপন করতে সক্ষম হয় তাহলে হয়ত অনুমান মিথ্যাও হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী জনমতকে নিশ্চয়ই উদ্যোক্তারা আমলে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেই অনুযায়ী তারা এগিয়ে গেলে হয়ত বাংলাদেশে বিএনপির পরের স্থানটি তাদের দখলে চলে আসতেও পারে। তেমন হলে আগামী সরকারে তাদের দেখা না গেলেও বৃহত্তম বিরোধী দলের আসনটি পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/এমএস